ভালোবাসার মানুষটির অবহেলায় বিদায়!
সিলেটের ওসমানী মেডিকেলের চিকিৎসক, অধ্যাপক মইন করোনায় আক্রান্ত হয়ে আজ ঢাকায় মারা গিয়েছেন। এমন চমৎকার একজন মানুষ, এভাবে হারিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে। তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। তার সম্পর্কে কোন কিছু আজ লিখবো না। এখন সবাই তার এবং তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাবে। আমি বরং তার প্রতি আমার ভালোবাসা এবং গভীর শ্রদ্ধাটুকু তুলে রাখলাম।
কিছু কথা না বললই না। এই জন্য লিখতে বসেছি।
আমরা যখন প্রায় দেড় মাস আগে থেকে বলে বেড়িয়েছি- দয়া করে সব বন্ধ করে দিন; আপনারা শুনেন'নি। একদম শুনেন'নি। আপনাদের হুজুর হুজুর করা লোকজন এসে উল্টো আমাদের বলেছে-আমরা নাকি আতঙ্ক ছড়াচ্ছি!
যেই লোক গুলো এইসব বলেছে, তারা এখন কোথায়? এরা তো সবাই এখন ঘরে ঢুকে বসে আছে! এতো ভয় কেন আপনাদের?
আপনারা না বলেছিলেন- গরমের দেশে করোনা হয় না? আপনারা না বলেছিলেন করোনা তেমন কিছু না। মাত্র এক ভাগ মানুষ মারা যায় কিংবা তার চাইতেও কম! আর আমরা শুধু শুধু আতঙ্ক ছড়াচ্ছি! তো, আপনারা এখন কোথায়? করোনা তো তেমন কিছুই না। এখন দয়া করে ঘরে না থেকে মানুষ গুলোর সেবা করুন না! করছেন নাকি?
যেই ডাক্তার আজ মারা গেল; সেও আমাদের দলে ছিল। সেও বুঝতে পেরেছিল- ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। সে হয়ত আমাদের মতো লেখালেখি করতো না। সে স্রেফ মানব সেবায় নিয়জিত ছিল। আপনাদের তেল দিয়ে বেড়ানো মানুষ গুলোর মতো বলে বেড়াত না- এইসব করোনা-টরনা কিছু'ই না।
এই ডাক্তারও বুঝতে পেরেছিল- সামনে মহা বিপদ। সব কিছু বন্ধ করে দিতে হবে। চিকিৎসকদের জরুরী প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুর জন্য জরুরী প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
আপনারা এর কিছুই করেননি। কারন, আপনাদের যারা বুদ্ধি দেয়, আপনাদের যারা উপদেষ্টা হয়- তারা এই দেশ কিংবা দেশের মানুষকে না; তারা স্রেফ ভালোবাসে তাদের নিজদেরকে এবং নিজেদের পদ এবং পদবীকে। আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ; কিংবা আজ যেই ডাক্তার মারা গেল; তারা করোনা রোগীর চিকিৎসা দিয়ে নিজে আক্রান্ত হয়ে সামান্য চিকিৎসা টুকুও পায় না।
সিলেট থেকে তাকে উড়িয়েও আনা যায়'নি। আনতে হয়েছে সড়ক পথে। পায়নি কোন ভেন্টিলেটর। এখন মোরে গিয়ে তিনি হয়ত বীরের মর্যাদা পাবেন। কারো কারো কাছে হয়ত তিনি করোনা যুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবেও বিবেচিত হবেন।কিন্তু বেঁচে থেকে সামান্য সম্মান টুকু কি এই মানুষটা পেয়েছে?
আমরা যারা নিয়মিত লেখালেখি করি, আমরা নানান বিষয়ে সমালোচনা করি। সেটা আমরা করি- যাতে মানুষ কিংবা দেশের উপকার হয়। কিছু কথা বলে নেই। কেউ কি আমাকে একটু বলবেন- দেশে যেই বাড়ির কোন লোক কিংবা মহিলা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে; সেই বাড়িটিতে লাল কাপড় কেন এখন টানিয়ে দেয়া হচ্ছে?
এর মানে কি? আমরা কি এখন সেই স্টেজে আছি? এটা তো আপনারা করতে পারতেন আজ থেকে দেড় মাস আগে। যখন করোনা ভাইরাস খুব একটা ছড়িয়ে পড়েনি। সেই ক্ষেত্রে যেই অল্প কিছু মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলো, তাদের কন্টাক্ট ট্রেস করে যাতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে না যায়; সেই ব্যবস্থা করা যেত।
কিন্তু এখন কোন হিসেবে আপনারা কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দিচ্ছেন? পুরো রাস্তা ব্লক করে দিচ্ছেন? কমিউনিটি ট্রান্সমিশন তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে এই দেশে। আপনি কি এই অল্প কিছু মানুষের কন্টাক্ট ট্রেস করে করোনা বিস্তার রোধ করতে পারবেন?
এখন তো সমাজে কিংবা দেশে এমন হাজার হাজার করোনা রোগী ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকের হয়ত কোন লক্ষনও নেই। এখন এই কাজ করছেন কেন?
দেড় মাস আগে যখন বলেছিলাম- তখন করলেন না। এখন কোন হিসেবে এই কাজ করছেন, সে আপনারা'ই ভালো বলতে পারবেন! এই সামান্য বুদ্ধি দেবার মতো মানুষ গুলোও কি আপনাদের কাছে নেই?
এতে কি হচ্ছে জানেন?
মানুষ মনে করছে- যারা করোনা রোগী, তারা অস্পৃশ্য! তাদের'কে সমাজ থেকে বের করে দিচ্ছে! কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে চাইছে না। অনেক'কে নানান ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে!
কাল পত্রিকায় পড়লাম, এক মাকে তার সব সন্তানরা মিলে গাজীপুরের জঙ্গলে ফেলে গিয়েছে! কারন ওই মার করোনা উপসর্গ দেখা দিয়েছিল! চিন্তা করা যায়? সন্তান'রা তাদের মাকে বনে-জঙ্গলে ফেলে চলে গিয়েছে!
আজ আবার জানতে পারলাম- এক পরিবারের চার জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে! পাঁচ সদস্যের ওই পরিবারের স্রেফ পাঁচ বছরের বাচ্চাটা ছাড়া আর সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এখন ওই বাচ্চাটার দায়িত্ব কোন আত্মীয়-স্বজন নিতে চাইছে না!
এইসব কেন হচ্ছে জানেন তো?
এই যে আপনারা করোনা নিয়ে আগে থেকে নানান সব আজব কথা বার্তা বলে বেড়িয়েছেন; এতে এইসব মানুষের মনে অন্য ধরনের একটা ধারণা কাজ করছে।
এই যে এখন লাল কাপড় বেঁধে দিচ্ছেন, এর কি কোন দরকার আছে?
কয়টা মানুষ'কে আপনি এখন এভাবে ট্রেস করতে পারবেন? কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গেলে এইসবে কাজ হবে না।
স্রেফ সবাই'কে বলতে হবে ঘরে থাকুন। সেটা করোনায় শনাক্ত রোগী হলেও যেমন ঘরে থাকতে হবে; না হলেও থাকতে হবে। আপনি হয়ত ১ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত করেছেন। আরও কয়েকশো হাজার করোনায় আক্রান্ত রোগী; যাদের হয়ত শনাক্ত করা সম্ভব হবে না কোন দিন; তাদের কি আপনি এভাবে লাল পতাকা দিয়ে আলাদা করতে পারবেন এখন?
সময়ের কাজ সময়ে না করে; এখন করছেন!
এখন বরং সবাই'কে যে করেই হোক ঘরে রাখুন।
তাছাড়া, মাত্র তো এক হাজারের মতো শনাক্ত করেছেন; যদি মনে করেন- এদের'কে আলাদা রাখবেন; রাখুন না আলাদা করে।
আলাদা কয়েকটা জায়গা প্রতিটা জেলায় তৈরি রাখুন। শনাক্ত রোগী; যাদের কিনা অবস্থা সম্পূর্ণ ভালো; খুব একটা স্বাস্থ্যের অবনতি হয়নি; তারা সেখানে থাকবে। যাদের অবস্থা খারাপ, তারা হাসপাতালে যাবে।
শহরের হাসপাতাল গুলোকে ব্যাবহার করতে পারেন এই জন্য। যদিও এভাবে আলাদা করে রেখে খুব একটা ফায়দা হবে না। কারন হাজার হাজার রোগী, যাদের শনাক্ত করা যায়নি; তার কিন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে!
তাই, এইসব লাল কাপড় লাগিয়ে দিয়ে কিংবা একটা বাসা বা গলি লক ডাউন করা বাদ দিয়ে বরং পুরো দেশ'টাকে লক ডাউন করুন। কোন মানুষকে বের হতে দিবেন না।
দেড় মাস আগে থেকে বলে যাচ্ছি- শুনলেন না।
আপনাদের জানিয়ে রাখি সুইডেন দেশটা ইউরোপের অন্য দেশ গুলোকে অনুসরণ না করে সব কিছু চালু রেখেছিল। এমনকি পুরো পৃথিবীতে নিজদের একটা আলদা ব্র্যান্ড করার চেষ্টা করেছিল সব কিছু খোলা রেখেও কি করে করোনা মোকাবেলা করা যায়!
ফলাফল কি হয়েছে জানেন?
দেশটি'তে এখন মৃত্যু'র মিছিল চলছে। সুইডেনে এখন প্রতি ৯০০ জনে এক জন করোনা রোগী! মাত্র ৯০ লাখ জনসংখ্যার দেশে এর মাঝে'ই হাজারের উপর মানুষ মারা গিয়েছে। আরও কতো হাজার মানুষ মারা যাবে; তার কোন ঠিক নেই।
কারন কিন্তু ওই একটা'ই। এরা সময় মতো সব কিছু বন্ধ করেনি। এখন মৃত্যু'র মিছিল মেনে নিতেই হচ্ছে ওদের। কফিন গুণছে এখন ওরা।
সুইডেনের মতো মানবিক দেশ; যাদেরকে বলা হতো "মানুষ আগের" দেশ। অর্থাৎ এই দেশ'টিতে সব সময় মানুষকে আগে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে; সেই দেশটি এইবার তাদের মানুষের বদলে অর্থনীতি'কে প্রাধান্য দিয়েছে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হয়; সেটা না হয় ভবিষ্যৎ'ই বলে দিবে।
সুইডেনের উদাহরণ'টা এই লেখায়া অবতারণা করলাম এই কারনে- এইসব দেশরাও ভুল করেছে। সুতরাং বাংলাদেশ ভুল করেছে; এটা খুব একটা বড় কিছু না।
পুরো প্রজন্মের কেউ'ই তো আর এমন অবস্থায় আগে পড়ে'নি। তাই ভুল হতেই পারে। কাউ'কে দোষ দিচ্ছি না। স্রেফ ভুল গুলো ধরিয়ে দিয়ে বলতে চাইছি- অন্তত আগামী'তে যাতে ভুল কম হয়।
আমি গত কয়েকদিন অতীতে হয়ে যাওয়া পৃথিবী ব্যাপী মহামারী গুলোর ইতিহাস পড়ছিলাম।
যেটা আবিষ্কার করাম- ওই সব ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবী'কে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
করোনা ভাইরাসও যে খুব দ্রুত চলে যাবে; এমন'টা আমার মনে হচ্ছে না। আমি জানি শত বছর আগে বিজ্ঞান খুব একটা এগিয়ে ছিল না। এখন অনেক এগিয়েছে। বিজ্ঞানীরা হয়ত দ্রুত'ই ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করে ফেলবে। সেই ক্ষেত্রেও দেড়-দুই বছরের আগে এটা কোন ভাবে'ই সম্ভব হবে বলে অন্তত আমার মনে হচ্ছে না। এর চাইতেও বেশি সময় লাগতে পারে।
তাই এখন থেকে'ই ভাবতে হবে- কিভাবে এই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায়। কারন এর সাথে অর্থনীতিও জড়িত আছে।
এটি কিন্তু একটি যুদ্ধ। আপনাদের জানিয়ে রাখি- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ বেঙ্গলে অর্থাৎ বাংলাদেশ কিন্তু দুর্ভিক্ষ হয়েছিলো। করোনা যুদ্ধও কিন্তু একটা যুদ্ধ। যেহেতু ব্রিটিশ শোষক'রা আমাদের স্রেফ শোষণ করে গিয়েছে; তাই বিশ্ব যুদ্ধের পর আমাদের মানুষদের পেটে খাবার দেবার বদলে, আমাদের জিনিস নিয়ে তারা নিজেদের মানুষকে খাইয়েছে।
এইবার করোনা যুদ্ধে যেন অন্তত তেমন না হয়। এখন'ই শুনতে পাচ্ছি- নানান ভাবে ত্রাণ সামগ্রী মেরে দিচ্ছে আপনাদের লোকজন। এই দিকে ভালো করে খেয়াল রাখুন। দরকার হয় সেনাবাহিনী দিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করুন।
সেই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন কিভাবে সচল রাখা যায়, সেটা নিয়ে এখন'ই ভাবতে বসুন। দরকার হয় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে দিন।
সাপ্লাই চেইন যাতে কোন ভাবে'ই ভেঙে না পড়ে। উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো এর মাঝে'ই এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। তাই আমাদেরও এই নিয়ে ভাবতে হবে। আশার ব্যাপার হচ্ছে- আমাদের অন্তত কৃষি জমি আছে; যেখানে ফসল ফলে। আছে কৃষকও এবং ব্রিটিশদের মতো কোন বিদেশি শোষক আমাদের নেই। তাই অন্তত আশা করা যায়, দুর্ভিক্ষে আমাদের মরতে হবে না; যদি না আপনাদের দলের লোকজন এই মহামারী'র মাঝেও দেশটাকে কেবল নিজেদের সম্পত্তি মনে করে লুটপাট করে বেড়ায়!
করোনা যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে।
আমি যেভাবে দেখছি- পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ এই যুদ্ধে মনোবল প্রায় হারিয়ে বসে আছে। এরা বুঝতে'ই পারছে না কি করা উচিত! এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কারা জয়ী হবে; কাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে; সেই হিসাব করার সময় হয়ত এখনও আসেনি। তবে আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি- আমরা যদি এখনও সঠিক ভাবে আগাই; এই যুদ্ধে আমরা টিকে থাকবো এবং কে জানে- হয়ত জয়লাভও করতে পারি।
স্রেফ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গুলো নিতে হবে।
নিজের একটা আকাঙ্খার কথাও জানিয়ে রাখি- করোনা যুদ্ধ আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে- কতোটা অমানবিক সমাজ আমরা গড়ে তুলেছিলাম। যেখানে মা-বাবা'কে ফেলে সন্তান চলে যাচ্ছে। কেউ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত সামনে আসছে না! এই যুদ্ধ হয়ত সামনে আমাদের আরও অনেক কিছু দেখাবে।
যখন এই যুদ্ধ থেমে যাবে; যদি বেঁচে থাকি- বড্ড ইচ্ছে আছে দেশে একটা স্কুল খোলার, সেখানে লেখাপড়া শিখে গাড়ি-বাড়ি চলার মন্ত্র শেখানো হবে না; যেখানে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীও দেয়া হবে না। যেখানে কোন অনার্স-মাস্টার্স-পিএচডি ডিগ্রী নেয়ার মন্ত্র শেখানো হবে না - শেখানো হবে স্রেফ কিভাবে মানবিক হওয়া যায়। কিভাবে মানুষ হওয়া যায়।