করোনাভাইরাস ও একজন ‘মানুষ ডাক্তার’ ফেরদৌস
ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে করোনাভাইরাস। এর আড়াই মাস পর গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর যারা মানবসেবার ব্রত নিয়ে চিকিৎসক হয়েছিলেন; তাদের মধ্য থেকে একদল নিজেরা ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজা, জানালা বন্ধ করে দিলেন, যাতে করে বাতাসের মাধ্যমেও ভাইরাস তাদের না ছুতে পারে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। একযোগে রোগী দেখা বন্ধ করে দিলেন।
সবাই আওয়াজ তুললেন, বাংলাদেশের সব ডাক্তারই খারাপ! তাহলে তো দেশের ১৭ কোটি মানুষের মরে ছাপা হয়ে যাওয়ার কথা। সবাই তো আর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারে না। কিছু ‘মানুষ ডাক্তার’ আছেন বলেই তো আমরা বেঁচে আছি। মানবসেবী সেই সব ‘মানুষ ডাক্তার’ ঢাল-তালোয়ার ছাড়া জীবন বাঁচাতে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়লেন। তারা নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতাল ছাড়াও ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর চিকৎসা সেবা দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন। রোগ থেকে সারিয়ে তুলছেন। আমি এমন একজন ‘মানুষ ডাক্তার ফেরদৌস আহম্মেদ (সহকারি রেজিস্ট্রার, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) এর কথা বলছি। একদিনের জন্যও রোগী দেখা বন্ধ করেননি। একবারের জন্যও কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেননি। হ্যা, ব্যক্তিগত জীবনে জানুয়ারি মাস থেকে নিজেকে একাকী রেখেছেন। একটি বারের জন্যও ছয় মাস বয়সী নিজের পুত্রটিকে আদর করেননি। বড় মেয়েটিকে ‘মা’ বলে ডেকে কোলে তুলে নেননি।
তার মোবাইল ফোনটি সারাদিন বেঁজে উঠে। তিনি ফোন তুলে এই দুর্যোগে সিরিয়াস না হলে চেম্বারে আসতে নিষেধ করেন। রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর ওষুধ দেন। বলবেন, এটা তো টেলি মেডিসিন। এ আবার নতুন কী? হ্যা, আমাদের নাক সিটকানোর অভ্যাস আছে। তাই বলছি, তিনি ২৪ ঘণ্টাই চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। বলবেন, কীভাবে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা দেবেন। তাহলে ঘুমান কখন, খান কখন, টয়লেটে যান কখন?
রাত তিনটা বাজে। এমন সময় মোবাইলে কল করে আপনার সুখ নিদ্রা ভঙ্গ করলে আপনিও দু’কথা শুনিয়ে দেবেন। বাচ্চার বয়স সাড়ে তিন বছর। জ্বর ১০৪ ডিগ্রি। অত্যাধিক তাপমাত্রায় নিস্তেজ শিশুটি। অস্থির মা-বাবা নানান কথা ভেবে ফোন করলেন, ডা. ফেরদৌসকে। অপর প্রান্ত থেকে আস্থার কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিন। সকালে যেই সাপেসোটেরি এনেছেন। তা, এখনি দিয়ে দিন। ইনশাল্লাহ জ্বর নেমে যাবে।’
হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসকরা বলেন, পিপিই পাননি। পিপিই ছাড়া রোগী দেখছেন কেন? তার সাফ উত্তর, মারা গেলে আমি আল্লাহকে কী জবাব দেব? আমি তো ডাক্তার হয়েছি মানুষের সেবা করতে। এই হচ্ছেন- আমাদের চল্লিশ বছর ছুই ছুই ডাক্তার ফেরদৌস। না, ‘মানুষ ডাক্তার’ ফেরদৌস।
বিশ্বব্যাপি মহামারি ছড়ানো এই করোনাভাইরাস আমাদের সামনে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে ‘মনুষত্ত্ব’ ও ‘মানবসেবা’। এই অদৃশ্য ভাইরাস পরাজিত হবে। মহাসংকট কেটে যাবে। আলো ফুটবেই। কিন্তু আমরা কতটুকু মানুষ হতে পেরেছি তার প্রমাণের সুযোগ এখনি।
আজ ‘মানুষ ডাক্তার’ ফেরদৌস আহম্মেদের মেয়ের জন্মদিন। তার বুকফাটা কষ্ট মেয়েটিকে ছুতে পারছেন না। অদৃশ্য ভাইরাসের জন্য জানাতে পারছেন না, জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আচ্ছা এই মানুষ ডাক্তার কী জানেন, তার জন্য কত হাত সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাইছেন। তার মঙ্গল কামনা করছেন। মেয়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে না পারার কষ্ট তার থাকতে পারে। কিন্তু অদৃশ্য ভালোবাসা, অদৃশ্য মঙ্গল কামনার সহস্র শুভেচ্ছা তার কষ্ট কমিয়ে দেবে নিশ্চয়ই। ভালো থাকুন ‘মানুষ ডাক্তার’রা। ভালো থাকুন আমাদের ডাক্তার ফেরদৌস।
লেখক: সাংবাদিক, কথা সাহিত্যিক ও গবেষক