১১ এপ্রিল ২০২০, ১৮:০১

করোনা যুদ্ধে জয় সম্ভব?

ইরফান রিয়াদ  © টিডিসি ফটো

যুদ্ধে যে পক্ষের গেরিলা যত ধুর্ত আর চৌকস সেই দলের জয়ের সম্ভাবনা তত বেশি। এজন্য একজন গেরিলাকে তার শত্রুর চেয়ে বেশি দ্রুত গতির হতে হবে। যত দ্রুত শত্রুপক্ষকে আক্রমন করা যাবে তত বাড়বে জয়ের আশা। মুর্দা কথা আপনার শত্রু যত দ্রুতগতি সম্পন্ন হবে, আপনাকে হতে হবে তার চেয়ে বেশি ধুর্ত আর দ্রত গতির।

চে গুয়েভারার সান্তা ক্লারাতে আক্রমণের গতি ছিল অবিশ্বাস্য। চে তার ধুর্ততা আর কৌশল দিয়ে পর্যদুস্ত করেছিল স্বৈরাচার বাতিস্তার সরকারকে। চে’র চৌকস গেরিলা আক্রমণে বাতিস্তা সদলবল নিয়ে কিউবা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। বিজয়ীর বেশে হাভানায় প্রবেশ করেছিল চে।

কথাগুলোর উদ্দেশ্য চে’র বীরত্ব বর্ণনা নয়। করোনার আক্রমণ প্রসঙ্গে এতোগুলো কথা বলা। করোনার আক্রমণের গতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই- করোনা ১ জনকে সংক্রমিত করতে পারলে সেই লোকটি আরো ৮০০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় এই মাইক্রোব মানুষের শরীরে প্রবেশ করে একাধিক দিন লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই আরো অনেক মানুষ সংক্রমণে সাহায্য করে। এমনকি এর আগে যত ভাইরাস এসেছিল তার চেয়ে বেশি দ্রুত ছড়াচ্ছে এই ভাইরাস।

MARS ভাইরাস ১ম ১০০০ জনে ছড়াতে সময় নিয়েছিল ৯০৩ দিন, SARS ভাইরাস ১০০০ জনে ছড়াতে সময় নিয়েছিল ১৩০ দিন আর করোনা ১ম ১০০০ জনে ছড়াতে সময় নিয়েছে মাত্র ৪৮ দিন।

এবার বুঝতে পারছি আমাদের শত্রু কতটা বেশি দ্রুত গতিসম্পন্ন। ২০৯ টি দেশ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। ১ম, ২য় বিশ্বযুদ্ধেও এত দেশ আক্রান্ত হয়নি। স্পেনের রাজকুমারী থেকে প্রিন্স চার্লস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেকে কুলি মুজুর সব শ্রেণিই আক্রান্ত। মৃত ১ লাখ ছাড়িয়েছে। এই ভাইরাস নিয়ে মানুষের নলেজ এখনো সীমাবদ্ধ। ভ্যাক্সিনও আবিষ্কার হয়নি।কাজেই কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সি, লকডাউন ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।

করোনার ফলে যে লকডাউন, আইসোলেশনের ফলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি তার পরিমাণ কত, ক্ষতি কমানোর উপায় কি, লকডাউন পরবর্তী অর্থনীতির পদক্ষেপ কি, কিছুই জানা নেই আমাদের।

ইজেন্সিয়াল সেক্টর, নন ইজেন্সিয়াল সেক্টর সব বন্ধ। নন ইজেন্সিয়াল সেক্টর খোলার কোন প্রশ্নই আসে না ধরুন, মিরপুরের সেলুনগুলো কবে খুলবে কারো জানা নেই, ওখানে যারা কাজ করে তারা কবে কাজ পাবে? পুরান ঢাকার রেস্টুরেন্ট গুলো কবে খুলবে, ওখানে যারা কাজ করতেন তারা কবে কাজ পাবে?

২/৩ মাস যদি নন ইজেন্সিয়াল মার্কেট বন্ধ থাকে তাহলে এই লাখ লাখ মানুষের খরচা কীভাবে চলবে? রাষ্ট্র কী পারবে এতো গুলো মানুষের দায়ভার নিতে? প্রধানমন্ত্রীর ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজের সুফল কতটা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই কয়দিনে করোনা আক্রান্ত রোগীর চেয়ে ত্রাণ চোরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

অঘোষিত লকডাউনের ১৮ দিনের মাথায় অনেক জায়গায় মানুষ ত্রাণ না পেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। লাগামহীন ত্রাণ চুরি কি পারবে সম্ভাব্য খাদ্যের সংকট আটকাতে? এই লকডাউন আরো একমাস চললে ত্রাণের সুষ্ঠু বন্টন কিভাবে সম্ভব হবে? বেশিরভাগ জায়গায় ত্রাণ বিতরণে মানা হচ্ছে না সোশ্যাল ডিস্টেন্সি। ফলে দ্রুত একটা কমিউনিটি সংক্রমিত হতে পারে।

করোনা যুদ্ধের প্রধান যোদ্ধা ডাক্তার। সেদিন সিলেটে করোনা আক্রান্ত এক ডাক্তার হাসপাতালে আইসিইউতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সংকট থাকায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বিভাগীয় শহর, গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরের হাসপাতাল গুলোতে আইসিইউ স্থাপন না করলে ঢাকামুখী রোগীর চাপ বাড়বে। রোগী স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় রোগ ছড়িয়ে পড়ার বেশ সম্ভাবনা থাকে।

আমাদের দেশে কমিউনিটি সংক্রমণ মানে সেটা লাখ লাখ ছাড়াবে, বাড়বে মৃত্যুর হার। আমাদের অসচেতনতা, দুর্বল চিকিৎসা অবকাঠামো, লাগামহীন ত্রাণ লোপাট কতটুকু পারবে আমাদের এই যুদ্ধে করোনার চেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন করতে?

ইতোমধ্যে আমাদের জিডিপি হার দ্রুতগতিতে কমছে, বেকারত্বের হার যেন আকাশচুম্বী। এর মধ্যে কমিউনিটি সংক্রমণ মানে দেশের দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।

আমাদের সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ও পরিষ্কার বন্টন হলে করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব। সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে ন্যাস্ত করলে ত্রাণ বিতরণে আসবে স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা। কমবে কমিউনিটি সংক্রমণের সম্ভাবনা। মেডিকেল সেবায় অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবেই নিশ্চিত হতে পারে সকলের নিরাপত্তা।

আমাদের সুশৃঙ্খল স্বচ্ছ পদক্ষেপই আমাদের করোনার চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন করতে পারে। এজন্য প্রতিটি নাগরিকের উচিত একজন গেরিলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তবেই আমরা এ যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো।

লেখক: শিক্ষার্থী আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস আ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট