বৈশ্বিক মহামারিকালে দেশগুলোর সমন্বয়হীনতা
করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণের কারণে সারাবিশ্বব্যাপী স্থবিরতা বিরাজ করছে। ১৯১৮ সালের প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লুর বিস্তারের পর বিশ্ব আজ আরেক ভয়ানক কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলা করছে। বিশ্বের দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় প্রথম ধাপে রীতিমত ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা বিস্তারের প্রথম পর্যায়ে চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহতা মানতে নারাজ ছিলেন। করোনা পরীক্ষা ও প্রতিরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কে এভাবে অসতর্কভাবে তারা নষ্ট করেছিল। যার মাশুল এখন গুনতে হচ্ছে বিশ্বকে।
ব্যয়বহুল লকডাউন জারি করার পর এই দুই পরাশক্তি একে-অন্যের বিরুদ্ধে দোষারোপের রাজনীতিতে নেমে পড়ে। এই দোষারোপের রাজনীতি এখনও চলমান রয়েছে। এ কারণে, এখনও দেখা যাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট, জেরুজালেম পোস্টের মত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হার প্রধান টেডরস আধানম গোরিয়াসেসকে জড়িয়ে চীনা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মুখরোচক সংবাদ প্রচারে ব্যস্ত।
পরস্পরকে এভাবে দোষারোপ করার খেলার শুরু করেছিল চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময় কি পরস্পরকে দোষারোপ করার জন্য উপযুক্ত সময়? এই প্রশ্নের উত্তরে নোবেলজয়ী অথর্নীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি নির্দেশনার উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সকলের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন সারাবিশ্বব্যাপী এখন সামগ্রিক সমন্বয়হীনতা, ঐক্যের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারাবিশ্বকে দেখিয়ে দিল বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা কত বেশি নাজুক। নাজুক হবে না কেন? বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অস্ত্র ভান্ডার এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যত ব্যয় করে ততটুকু ব্যয় তো স্বাস্থ্যখাত, চিকিৎসাখাত উন্নয়নে করে না।
পরাশক্তিগুলোর এই আধিপত্য বিস্তারের খেলায় পতন ঘটেছে তাদের নীতি ও নৈতিকতার। চীন ও আমেরিকার দ্বি-পাক্ষিক সর্ম্পকের অবনতি ঘটেছে কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগেই। পারস্পারিক আস্থা তৈরি করতে হবে দুই পক্ষের মধ্য। যদি চীন তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গুগল, ফেসবুক তার নিজ দেশে বন্ধ করতে পারে, তাহলে আমেরিকা পারে তার দেশে হুয়াওকে, জেডটিইরের বিক্রয় বন্ধ করতে।
দুইদেশের রাজধানীতে একে অপরকে অবিশ্বাস, ক্ষোভের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকট আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে? কোভিড-১৯ শিক্ষা দিচ্ছে যে, জাতীয় নিরাপত্তায় আমাদের প্রস্তুতি কত নাজুক। বাণিজ্য যুদ্ধের মাধ্যমে এই দুই পরাশক্তি অথর্নৈতিক বিশ্বায়নকে প্রভাবিত করতে পারলেও প্রকৃতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রন নেই। ব্যবসার বিস্তার, শক্তির বিস্তার হচ্ছে এক ধরণের লাভ-ক্ষতির খেলা।
জলবায়ু পরিবর্তন, করোনার মত বিষয়গুলোকে এরকম কোন লাভ-ক্ষতির খেলা না ভেবে এগুলো মোকাবিলায় বৈশ্বিক সমন্বয় ও ঐক্য দরকার। বৈশ্বিক মেরুকরণ রাজনীতির পতন ঘটিয়ে দিল করোনা সংকটকাল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের জনগণের নিরাপত্তার জন্য যখন জার্মানি ও ইউরোপের মাস্ক ছিনতাই করেন এবং বন্ধুপ্রতীম ভারত হাইড্রোক্সিক্লোরাকুইনের না দিলে প্রতিহতের ভীতি দেখায়, তখন এই শক্তিশালী রাষ্ট্রের শক্তিশালী নেতা কতটুকু সম্মোহন শক্তিবিহীন নেতা তা প্রতীয়মান হয়।
সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত বৃহৎ জোটে। দুর্লভ দৃশ্য হয়ে উঠেছে ইউরোপের সংহতিবোধ ও ঐক্যে। এই দুঃসময়ে ঠিকই শিল্পোন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোকে চিকিৎসা সহায়তার জন্য চীন ও কিউবার মত দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। মের্কেলের মতো নেতারা আজ জটিল নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে অথর্নৈতিক প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তার উদার প্যাকেজ থেকে সরে এসেছে।
সারা বিশ্বব্যাপী আজ এই দুর্দিনে তাই সকলে একজন যোগ্য নেতার অভাব যেমন অনুভব করছেন তেমনি সমন্বয়হীনতা ও ঐক্যের অভাব দেখতে পাচ্ছে। এরকম সংকট থেকে উত্তরণের জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে সকল ভেদাভেদ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভুলে গিয়ে নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসতে হবে। কোভিড-১৯ হচ্ছে বিশ্বের বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর জন্য একধরনের সংহিত তৈরি ও সংহতি বজায় রাখার পরীক্ষা।
এই সংকটকালে, ছোট, বড় রাষ্ট্রকে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবিক হয়ে উঠতে হবে। নিজেদের মধ্য তথ্য বিনিময়, চিকিৎসা উপকরণ বিনিময়, অর্থ সহায়তা বৃদ্ধি সর্বোপরি আস্হার সর্ম্পক তৈরি জরুরি হয়ে উঠছে। নতুবা, করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী ভয়াল অথর্নৈতিক মন্দা মোকাবিলা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা