মুসলমানদের বোকা বানিয়ে হত্যার দিন ‘১ এপ্রিল’
সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে আরব উপদ্বীপে যে ইসলামের জয়যাত্রা বিঘোষিত হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে তা আরব ভূখন্ড পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের কালেমা খচিত বিজয় নিশান এশিয়া হতে আফ্রিকা এবং আটলান্টিকের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত উড্ডীন হয়।
ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়ে ইউরোপের ভূখন্ডেও। অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের অত্যাচারী খ্রিস্টান রাজা রডরিকের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ জনগণকে মুক্তি দেয়ার জন্য মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনে যে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন তা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় আট’শ বছর।
এসময় মুসলিমদের নিরলস প্রচেষ্টায় স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছিল। স্পেনের ইতিহাসে এ স্বর্ণালী সময়ের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গ্রানাডা, আল হামরা প্রাসাদ, কর্ডোভা, সেভিজা, টলেটো ও হাজার হাজার মুসলিম স্থাপত্য। এক কথায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক উজ্জলতম পাদপীঠ ছিল স্পেন। ইউরোপের বুকে একমাত্র মুসলিম ভূখণ্ড ছিল বলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয় রেনেসাঁর উন্মেষে অনবদ্য অবদান রেখেছে স্পেনের মুসলিম সভ্যতা।
মজার কথা হলো মুসলিম স্পেন যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা ও সংস্কৃতি চর্চায় নিমগ্ন তখন ইউরোপ অজ্ঞতা-বর্বরতায় ছিল নিমগ্ন। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, ‘All Europe was then plunged in barbaric ignorance and savage manners.’ অর্থাৎ তখন গোটা ইউরোপ বর্বর অজ্ঞতা ও বুনো ব্যবহারে নিমজ্জিত ছিল।
স্পেনের কর্ডোভা ছিল স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। কর্ডোভার সভ্যতা আর জ্ঞান শিখা সমগ্র ইউরোপ গগণে রবি রশ্মির ন্যায় বিচ্ছুরিত হতো। এজন্য সেই সময় কর্ডোভাকে ইউরোপের বাতিঘর বলা হতো। কর্ডোভার অনবদ্য অবদান ও কীর্তি দেখে জার্মানির এক মঠবাসী সন্ন্যাসী বিমোহিত হয়ে বলেছিলেন, Cordova,The Jewel the World.
তৎকালীন স্পেনে জ্ঞান চর্চা এতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বিখ্যাত ওলন্দাজ ঐতিহাসিক ডোজি তাঁর বিখ্যাত Spainish Islam গ্রন্থে উদার চিত্তে স্বীকার করেছেন যে, ‘স্পেনের প্রতিটি নাগরিক লেখাপড়া জানতো। অথচ সেই সময় সমগ্র ইউরোপ অজ্ঞতা ও মূর্খতায় নিমজ্জিত ছিল।’
স্পেনে মুসলিমদের শাসনের ফলে দেশটিতে যখন অর্থসম্পদ, বিত্ত-বৈভব প্রাচুর্যের জোয়ার বইছিল তখন মুসলমানরা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা ৷ নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে তাদের গ্রাস করে ফেলে ৷ ইসলাম প্রচার ও প্রসারের তারা ছিল উদাসীন। এসব দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিষ্টান জগত্ মুসলিম শাসনের শেষদিকে অর্থাৎ ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুসলিম শাসকদের নৈতিক অধঃপতন শুরু হলে স্পেনের ভাগ্যাকাশেও দেখা দেয় তমসার ঘনঘটা।
আশপাশের খ্রিস্টান রাজারা ক্রমাগত আক্রমণ করতে থাকে স্পেনের মুসলিম রাজ্যসমূহে এবং তারা মেতে উঠে বহুমুখী ষড়যন্ত্রে। খ্রিস্টানরা সিদ্ধান্ত নেয়, স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করার ৷ আরগুনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং কাস্তালিয়ার পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা এই দু’জনই চরম মুসলিম বিদ্বেষী খ্রিস্টান নেতা পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করে মুসলমানদের উপর আঘাত হানবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তারা মুসলমানদের দুর্বলতার উপযুক্ত সুযোগ খুঁজতে থাকে ৷
আবুল হাসানের পুত্র আবু আব্দুল্লাহ বোয়াবদিল খ্রিস্টান শহর লুসানা আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী হন। ফার্ডিন্যান্ড বন্দী বোয়াবদিলকে গ্রানাডা ধ্বংসের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। একদল সৈন্য দিয়ে বোয়াবদিলকে প্রেরণ করে তারই পিতৃব্য আল-জাগালের বিরুদ্ধে। এবার চাচা ভাতিজা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পিতৃব্য আল-জাগাল বোয়াবদিলকে যৌথভাবে রাজ্য শাসনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বোয়াবদিল এতে রাজি না হয়ে ফার্ডিন্যান্ডের ষড়যন্ত্রে পা দেন।
ইত্যবসরে খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে তৎকালীন রাজধানী গ্রানাডায়। এতদিনে টনক নড়ে মুসলিম বাহিনীর। কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্ডিন্যান্ড পা বাড়ায় ভিন্ন পথে ৷ তার নির্দেশে আশপাশের সব জমির শস্য ও খামার জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৷ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা ৷ অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহর জুড়ে ৷
দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করল তখন এই সুযোগে চতুর ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করে। প্রথমত: মুসলমানেরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয়, তাহলে তাদেরকে বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে। দ্বিতীয়ত: যারা খ্রিস্টান জাহাজগুলোতে আশ্রয় নিবে, তাদেরকে অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যথা আমার হাতে তোমাদেরকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে।
দুর্ভাগ্য তাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় মুসলমান আবাল বৃদ্ধা বনিতাদের করুণ মুখের দিয়ে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক৷মুসলমানরা সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় মসজিদে ৷ শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী, মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয় ৷ এরপর একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে পাশবিক উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনার মতো ৷
মসজিদের ভেতরে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু আর্তনাদ আর রোনাজারি করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় ৷ এদিকে জাহাজ গুলোকে সাগরের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
কেউ উইপোকার মতো আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল, কারো হলো সাগরে সলিল সমাধি। বলা হয়ে থাকে প্রজ্জ্বলিত আগুনে ভস্ম হয়ে ৭ লক্ষাধিক অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকারে যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুলেছিল, তখন হিংস্রতার নগ্নমূর্তি ধারণ করে ফার্ডিন্যান্ড আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্ত্রী ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে অট্র হাসিতে ফেটে পড়ে আর বলতে থাকে, 'Oh! Muslim! How fool you are!' (হায় এপ্রিলের বোকা!) শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে?’
দিনটি ছিল ১ এপ্রিল ১৪৯২। সেই থেকে খ্রিষ্টান বিশ্ব প্রতি বছর ১ এপ্রিল সাড়ম্বরে পালন করে আসছে এইদিনটি। April Fool মানে এপ্রিলের বোকা ৷ কিন্তু আফসোস! বিলাস বসনে মত্ত হয়ে মুসলমানরা ইসলাম থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলে তাদের জীবনে সীমাহীন দুঃখই কেবল নেমে আসেনি, তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে স্পেনের মাটি থেকে ৷ এপ্রিল ফুল পালন করা মুসলমানদের জন্য চরম লজ্জাজনক ও অবমাননাকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
সুতরাং এ থেকে বিশ্বাসী মুসলমানদের বিরত থাকতে হবে এবং কোনো মুসলমানের সন্তান যেন এ দিনে ধোঁকা না দেয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। এপ্রিল ফুলের সেই ধোঁকা থেকে সকলকে বিরত রাখতে হবে। সমাজে প্রচলিত এ এপ্রিল ফুল কালচার বা সংস্কৃতি ইসলামে বিবেক বর্জিত আদর্শহীন অসুস্থ ও অসুন্দর সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। অন্য হিসেবে স্পেনে মুসলিম নিধন হিসেবে যদি কেউ ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন করে তবে তা হবে সর্বকালের সেরা নিষ্ঠুর সংস্কৃতি।
বিশুদ্ধ ইতিহাসে উপরিউক্ত ঘটনার তেমন বর্ণনা পাওয়া যায় না। অনেকে এই ঘটনাকে মিথ বলে উড়িয়ে দেন। পাশ্চাত্য ১ এপ্রিল বসন্ত উৎসব, মেলা বসতো ইংল্যান্ডে। যারা নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে বিদায় দিয়েছিলো তারা বিদ্রুপ করে অন্যান্য যারা তখনো জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষ গনণা করতো তাদেরকে বোকা বানাতে ১ লা এপ্রিলে নববর্ষের উপহার পাঠাতো।
এতে প্রাচীনপন্থীরা বোকা বনে যেতো এবং নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারধারীরা উপহার পাঠিয়ে তাদেরকে পশ্চাদপদ বলে উপহাস করতো। বিভিন্ন দেশে প্রাচীন কাল ধরে এটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় - April Fools’ Day, also called All Fools’ Day, in most countries the first day of April. এপ্রিল ফুল দিবসকে অনেক দেশে ‘অল ফুলস ডে’ নামেও ডাকা হয়।
মুসলমানরা আত্মসম্পর্ণ করেছিল ১ এপ্রিল নয়, কাহিনীর ৫৮ দিন আগেই রাণী ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার দখল চলে যায় তখন আত্মসমর্পণ করে! ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহর সাথে ইসাবেলা আর ফার্ডিন্যান্ডের চুক্তি হয়েছিল। যেমন বলা হয়, The end of Muslim rule at the heart of Spain came to an end on January 2, 1492 when Boabdil relinquished the keys to the Moorish capital to King Ferdinand and Queen Isabella. (A History of Medieval Spain)।
চূড়ান্তভাবে মুসলমানদের স্পেন ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল ১৬০৯ সালের পর। রানী ইসাবেলা স্পেন থেকে মুসলিম শাসন হটাতে আস্তে আস্তে ছোট ছোট এলাকা দখল করে নিয়ে এগিয়ে যান। ইসাবেলা ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি স্পেনের শেষ মুসলিম শাসনের খলিফা দ্বাদশ মোহাম্মদের হাত থেকে শান্তিপূর্ণভাবে নগরের চাবি গ্রহণ করেন।
Henry Kamen এর Spain 1469 – 1714; A Society of Conflict থেকে আমরা জানতে পারি, স্পেনের শেষ মুসলিম শাসক আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ স্প্যানিশ নাম বোয়াবদিল। রাণী ইসাবেলা-ফার্ডিনান্ডের কাছে আত্মসমর্পন করেন ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি। বোয়াবদিলের এর সাথে রাণীর চুক্তি হয়েছিল স্পেনে বসবাসরত মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দানের, সে চুক্তি রক্ষিত হয়নি, আত্মসমর্পন পরবর্তী সময় থেকেই মুসলমানদের ওপর নানানভাবে জুলুম শুরু হয়। ধ্বংসযজ্ঞ মূলত শুরু হয় ১৫০৮ সালে ইহুদী এবং মুসলমানদের হয় ক্যাথলিক হতে হবে নয়তো স্পেন ছাড়তে হবে।
এটি ইনকুইজিশন নামে পরিচিত। ১৪৯৬ সালে ইসাবেলার সম্মতিতে আর্চবিশপ তালাভ্যারা আলহামরা নাম একটি ডিক্রি জারি করেন। এই ডিক্রি অনুসারে স্পেনের ইহুদী ও মুসলমানদের হয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করতে হবে নয়তো দেশ ত্যাগ করতে বলা হয়। ১৫০২ সালে ইসাবেলা ইহুদী-মুসলিম ও অন্যান্য খ্রিস্টানদের বাধ্যতামূলক ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হবার অথবা, দেশত্যাগের আদেশ দিয়ে সরকারি এক ফরমান জারি করে।
গ্রানাডার পতনের পর প্রায় ১ লক্ষ মুসলমান মারা যায়, ৪ লক্ষ মুসলমান দেশত্যাগ করে ও ৩ লক্ষ মুসলমান ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। ইহুদীদের ইতিহাস আরো করুণ। ২ লক্ষ ইহুদী মারা যায়, ১ লক্ষ ইহুদী ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয় এবং ১ লক্ষ ইহুদি দেশত্যাগে বাধ্য হয়। স্পেনের ইতিহাসে কোথাও মসজিদে আটক করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার উল্লেখ নেই। মুসলমানদের এই পুড়িয়ে মারার গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিও নেই বলে অনেকের অভিমত।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক