ফেসবুকে করোনা আতঙ্ক, জনজীবনে আরেক বিপর্যয় কি?
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাড়া-মহল্লায় করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে একশ্রেণীর লোক এবং অনেকক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়া ভুয়া তথ্যে আমরা বিনা কারণেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। আতঙ্কের ছড়াছড়িতে কোনো কোনো সময়ে বিরক্তিকর পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে যা দেশের এমন অবস্হায় কোনো নাগরিকের কাছ থেকে কাম্য নয়।
ঋতু পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বাসায় বাসায় সর্দি-কাশি হবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু হঠাৎ করে করোনার প্রাদুর্ভাবে বদলে গেল সবকিছু। করোনার উপসর্গ হিসেবে সর্দি-কাশি থাকায় জনজীবনে একধরণের স্হবিরতা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে হোমকোয়ারেন্টিনে না থেকে অন্যত্র ঘুরে বেড়ানো বিদেশফেরত ভাইদের নিয়ে তো শঙ্কার শেষ নেই। আবার করোনা ভাইরাসের কারণে ‘খুক খুক কাশি’ ও সর্দি থাকলে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করেছে বলে একধরণের সন্দেহের চোখেও দেখছি।
তাতে দেখা যায়, অন্যদের মাঝে একধরণের আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কোনটা করোনা ভাইরাস আর কোনটা ঋতু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তন ঘটছে তা বুঝা মুশকিল। অন্যদিকে করোনার সংক্রমন যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্যে সর্দি-কাশি সম্পর্কেও বিভিন্ন রোগীকে বাসায় নিয়মিত যত্ন নিতে বলছেন চিকিৎসকরা। সেজন্য বাসায় বসেই জনমনে আতঙ্ক যেন পিছু ছাড়ছে না যে, জনজীবনে সর্দি-কাশির মধ্যেই বাসা বেধেছে কিনা মারণাত্মক করোনা ভাইরাস!
ফেসবুকে সব ইস্যু ছাপিয়ে বর্তমানে সকল শ্রেণির মানুষ ব্যস্ত এখন করোনা’ আতঙ্কে। করোনা ভাইরাস সংক্রমন ও নিজেকে রক্ষার বিষয়ে অনেকে ফেসবুকে নানা পোস্ট করছে। সত্য-মিথ্যে যাচাই-বাছাই না করেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন তথ্য। অজান্তেই ভালোকে খারাপ এবং খারাপকে ভালো বলা হচ্ছে।
করোনায় মৃত্যু নিয়েও গুজব সৃষ্টিতে পিছিয়ে নেই কেউ কেউ। অনেকে আছেন যারা লাইক, কমেন্ট'স ও ফলোয়ার বাড়ানোর ধান্ধায় বেছে নিয়েছে নিয়মিত পোস্ট। কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়ে জনমনে হৈচৈ সৃষ্টিতে মনগড়া অডিও ও ভিডিও ক্লিপ ছাড়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশের মানুষকে সচেতনতা অপেক্ষা গুজব ও আতঙ্কিত করতে ব্যস্ত এই শ্রেণীর লোকদের আইনিভাবে রুখতে হবে নতুবা তারাই করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্হিতি সৃষ্টি করবে। হোয়াটসঅ্যাপে ব্যক্তিগত সংযোগ এবং বিভিন্ন গ্রুপে বার্তা বিনিময়ে শুধুই আতঙ্কের করোনা। সবাই যেন সবজান্তা, বিশেষজ্ঞের ভূমিকা পালন করছে এবং সবার তথ্যভাণ্ডার করোনা-র তথ্যে পরিপূর্ণ এমনটাই নিজস্ব আঙ্গিকে অনেকে গুজব ছড়াচ্ছে ফেসবুক একাউন্টের মাধ্যমে।এতে যত তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ততই শেয়ার হচ্ছে এবং এভাবেই বিভিন্ন গুজবে ও আতঙ্কে পুরো দেশ।
তাই জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ও গুজবকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেওয়া জরুরি। না হয় করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যতোটা না ভীত হবে মানুষ তারচেয়েও বেশী সমস্যায় পড়বে গুজব ও জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর ফলে। তাই স্যোশাল মাধ্যমে কোনো প্রকার আতঙ্ক সৃষ্টি না করে আমাদের এ বৈশ্বিক স্বীকৃত মহামারিকে সচেতন চিত্তে প্রতিরোধ করতে হবে। যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তাদেরকে কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং তারা আক্রান্ত বলেই যে তাদের জন্যে এটা অভিশাপ ছিল তা বলা মোটেও ঠিক হবেনা।
অতএব ভাইরাস মোকাবেলায় আক্রান্ত ও অনাক্রান্ত সকলকে সচেতন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যগত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। টেলিভিশন খুলে বসতেই দেখি করোনা ভাইরাসের সংবাদ সকলক্ষেত্র জুড়ে। করোনার প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমছে, চাকরি হারানোর শঙ্কায় হাজারো মানুষ,সচল অর্থনীতিতে মন্দার ঢেউ।
বৈশ্বিকভাবে কোন কোন দেশে কতোজন আক্রান্ত, কতজন সুস্হ হয়েছেন কিংবা কতজন মারা গেছেন। বিশ্বের নামীদামী খেলোয়ার,গায়কদের কেউ কোয়ারেন্টিনে আবার কেউ করোনায় আক্রান্ত। তাদের আক্রান্তের খবরে যেন সেই ঢেউও লেগেছে জনতার। করোনা সংক্রমন ঠেকাতে রাশিয়ায় মানুষকে ঘরে ফেরাতে সিংহ ছেড়েছেন রাস্তায় আবার
অন্যদিকে ইতালির সরকার করোনার সংক্রমন ঠেকাতে না পেরে সব আশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। লক ডাউনের ব্যাপারেও বিভিন্ন সমালোচনার শেষ নেই।
এভাবে যারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াচ্ছেন এবং সহজ উপায়ে করোনা প্রতিরোধ করা যাবে বিভিন্ন ফতুয়া দিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরি।
কারণ তাদের জন্যে সরকারের সচেতনতা বিফলে যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষও এটাকে তোয়াক্কা না করে ছোঁয়াচে ভাইরাসে সংক্রমণের হার আরো বৃদ্ধি করবে।
তাই আমাদের মধ্যে যে ভ্রান্ত ধারণাগুলো এই ব্যাপারে রয়েছে, তা নিরসন করা জরুরী এবং সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধিনিষেধ মেনে চলা জরুরি। তাছাড়া অন্যদিকে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে অনেকে চিন্তিত। কিন্তু খাবারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে এসব ব্যাপারেও রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শোরগোল।
তাই পরিবারে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। নিজেদের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী যেভাবে রান্না করে (ফুটিয়ে ও সেদ্ধ) বাড়িতে খাই, সেভাবেই খাওয়া উচিত। মুরগি বা অন্য কোনও প্রাণীর মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় না। তাই নিশ্চিন্তে মাংস ও ডিম চলতে পারে। প্রাণীজ প্রোটিন যেহেতু রোগ প্রতিরোধী সক্ষমতার জন্য জরুরি, আতঙ্কিত হয়ে আমিষ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।
করোনা ভাইরাস যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, সর্দি থেকে ছড়ায় তাই এ ব্যাপারে বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অভ্যেসে পরিণত করতে পারলে শুধু করোনা ভাইরাস নয়, যে কোনও রোগ–জীবাণু প্রতিহত করা সম্ভব।পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা, নাকে–মুখে অকারণে হাত না দেওয়া এবং হাত ধুয়ে খাবার খাওয়ার অভ্যাস তো প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সারা জীবনের জন্য দরকার।
বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন,করোনা ভাইরাস সমন্বিত জলকণা বেশি দূরে যেতে পারে না। যায় মাত্র ১–২ মিটার পর্যন্ত। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে চেয়ার, দরজার হাতলের মতো কোনও অজৈব বস্তুর ওপর সহজেই পড়ে যায়। আর জলকণায় অবস্থিত ভাইরাস এই জিনিসগুলোর ওপরের স্তরে বেশ কয়েক ঘণ্টা, এমনকি দুই দিন পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় থেকে যায়। ভাইরাস শরীরের কোষের বাইরে এই রকম নির্জীব অবস্থায় থাকতে পারে। পরবর্তীতে সজীব কোষের সংস্পর্শে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং কোষের ভিতরে ঢুকে সজীবতা দেখায় ও নিজের অপত্য তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়। অর্থাৎ, অজৈব পদার্থের ওপরের স্তর থেকে এই ভাইরাস হাত, রুমাল বা কাপড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।তাই সাবধানতা অবলম্বন সবার দায়িত্ব।
অন্যদিকে আতঙ্কের মধ্যেই একদল অসাধু ব্যবসায়ী বিপুল টাকা কামানোর স্বপ্নে দিন গুনছে। মাস্কের কালোবাজারি শুরু করেছে। স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। রেকর্ড বিক্রি। এ নিয়েও চলছে যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও আতঙ্ক। বিভিন্ন গুজব ও আতঙ্কের কারণে বাজারও অস্হিতিশীল প্রতিনিয়ত।
তাই এসবের ব্যাপারে সরকার ও সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে। সবশেষে বলবো যে, যেকোনো প্রকার গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে অবস্হান থেকে এ ভাইরাসের সংক্রমন রোধ করা প্রতিটা নাগরিকের দায়িত্ব। কারণ দেহের স্পর্শে এ ভাইরাসটি অবস্হান করে। সাবান–জলে হাত ধুয়ে পরিস্কার থাকাও আমাদের সংক্রমন ঠেকানোর সহজ উপায়। কারণ সাবান হাতের তালুর ওপর স্তরে থাকা ভাইরাস কণাগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভেঙে দেয়।ফলে হাতের তালুতে কোনো সংক্রামক কিছু থাকে না।