বাবার চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি: করোনায় মৃত অধ্যক্ষের ছেলের স্ট্যাটাস
গতকাল শনিবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ। মৃত্যুর আগে করোনা পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন হাসপাপতাল এবং আইইডিসিআর এর সাথে যোগাযোগ করেও টেস্ট করাতে পারেননি বলে অভিযোগ অধ্যক্ষের ছেলের।
রবিবার নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অভিযোগ করে বাবার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না করতে পারার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। সেই সাথে তার পরিবার নিয়ে ছড়ানো গুজবের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নিচে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল..
‘‘পিতার মৃত্যু এবং সন্তানের ব্যর্থতা- আমি কখনো ভাবি নি যে আমার পিতার মৃত্যুর ঘটনা আমাকে এই ভাবে লিখতে হবে কিন্তু কিছু মিডিয়ার মিথ্যা রিপোর্ট দেখে আমি বাধ্য হলাম ফেসবুকে কিছু সত্য প্রকাশ করতে।
গত ১৬ তারিখে আব্বা অসুস্থ বোধ করলে আমাদের ড্রাইভার ঐ দিন বিকালে উনাকে কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসে। ঐ সময় আমরা ভাইরা সবাই অফিসে। আমি অফিস থেকে বাসায় এসে শুনলাম ডাক্তার সাসপেক্ট করছে, উনার করোনা হয়েছে এবং কোভিড-১৯ টেস্ট এর জন্য সাজেস্ট করেছে। অতঃপর ঐ রাত্রেই আমরা উক্ত টেস্ট এর জন্য আইইডিসিআর এর হান্টিং নাম্বারে ফোন দেওয়া শুরু করি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করতে সামর্থ্য হই, তারা আমাদেরকে জানায় যেহেতু অসুস্থ ব্যক্তি বিদেশ ফেরত না এবং বিদেশ ফেরত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে উনি আসেননি সেহেতু এই টেস্ট উনার জন্য প্রযোজ্য নয়। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, উনি নিয়মিত মসজিদে যান এবং ঐখান থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে কি না। তারা আমাদের বললেন যে, এই ভাইরাস বাংলাদেশের কমিউনিটিতে মাস লেভেলে এখনো সংক্রমিত হয়নি। সুতরাং আপনারা চিন্তা করবেন না, এটা সাধারণ শ্বাস কষ্টের প্রব্লেম।
ঐ রাতেই আনুমানিক সাড়ে ১০ টায় আমি উনাকে শ্যামলীর একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং আমাদের পরিচিত একজন স্পেশালিষ্ট ডক্টরকে দেখাই। উনি আমাকে বলেন, রুগীর নিউমোনিয়া হয়েছে, উনাকে নিউমোনিয়ার ট্রিটমেন্ট দিতে হবে, তবে বাংলাদেশের কোনো হাসপাতাল এই রোগী ভর্তি নিবে না, আপনারা বাসায় ট্রিটমেন্ট করেন। আমি ঐ রাতে বাসায় চলে আসি এবং আব্বাকে নেবুলাইজার এবং মুখে খাওয়া এন্টিবায়োটিক দিতে থাকি।
পরের দিন ১৭ তারিখে দুপুরে আমি আব্বাকে নিয়ে যাই শ্যামলীর ঐ হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে। তারা রোগী দেখে বলেন যে, রোগীর অবস্থা ভালো না, উনাকে আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হবে কিন্তু তাদের আইসিইউ তারা দিতে পারবে না। এরপর আমি কেয়ার হাসপাতালে কথা বলি। ওরা বলে ওদের আইসিইউ খালি আছে। আমরা দ্রুত আব্বাকে নিয়ে কেয়ার হাসপাতালে যাই এবং আইসিউতে ভর্তি করি। ১৫ মিনিট পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের বললেন, এই রুগী তারা রাখতে পারবে না। অতঃপর আমরা রুগী নিয়ে কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে যাই। তারা আমাদেরকে কেবিন দিয়ে সাহায্য করে কিন্তু তাদের আইসিইউ খালি নেই।
আমি তখন স্কয়ারে ফোন দিলাম আইসিইউ এর জন্য। কিন্তু স্কয়ার আমাদেরকে বললো, রুগী ছাড়া শুধু কাগজ পত্র নিয়ে আসতে। তারা কাগজ পত্র দেখে ভালো মনে করলে রুগী ভর্তি করবে। রাত আনুমানিক সাড়ে ১২ টায় হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে বললেন এই রোগীর আইসিইউ লাগবে, আপনারা দ্রুত আইসিইউ এর ব্যবস্থা করেন। আমি বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলতে থাকি, কোথাও আইসিইউ খালি নেই। অতঃপর ডেল্টা হাসপাতাল তাদের আইসিইউ দিতে রাজি হয়। আমি এবং আমার ছোট ভাই রাত ৪ টার সময় আব্বাকে নিয়ে ডেল্টাতে আসি এবং দুপুর ১২টার পর থেকে আব্বা লাইফ সাপোর্টে চলে যান। ১৮ তারিখ দুপুর থেকে আমরা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইইডিসিআর এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। অতঃপর ১৯ তারিখ বিকালে আইইডিসিআর রাজি হয় এবং রাততে টেস্ট করে এবং পরের দিন ২০ তারিখ দুপুরে তারা আমাদেরকে জানায় যে রিপোর্ট পজেটিভ। আমাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলে ১৫ দিন।
রিপোর্ট পজেটিভ আসার পর থেকে ডেল্টা হাসপাতাল আমাদের প্রেশার দিতে থাকে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেওয়ার অনুমোদন দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা অনুমতি না দিয়ে তাদেরকে বলতে থাকি ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আর রোগীর কাছেও যায় নি এবং আমাদেরকে আইসিইউ এর ভেতর ঢুকতেও দেয়নি। যাই হোক আমার আব্বু অবশেষে ২১ তারিখ ভোর তিনটার সময় ইন্তেকাল করেন।
পিতার সঠিক ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে এমনকি তার জানাজাতে উপস্থিত থাকতে আমরা সন্তান হিসেবে ব্যর্থ। সন্তান হিসেবে, একজন পুত্র হিসেবে এর চেয়ে কঠিন কষ্ট আর কিছুই হতে পারে না। আমরা বুকে পাথর বেঁধে বাসায় অবস্থান করছি সরকারের আইন মেনে ১৫ দিনের জন্য। কিন্তু কিছু পেইজ এবং ফ্রন্ট লাইনের মিডিয়া আমাদেরকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যে, আমার ভগ্নীপতি বিদেশ থেকে আমাদের বাসায় এসেছে, যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।
আমার দুই ভগ্নীপতি। বড় বোন এবং তার হাজবেন্ড চিটাগাং এর দুটি সরকারি কলেজের অধ্যাপক। অন্য ভগ্নীপতি জাপান থাকে। সে গত এক বছরের মধ্যে দেশে আসেনি। আমার বাবা যেদিন আইসিউতে লাইফ সাপোর্ট এ চলে যান সেদিন আমার বড় বোন এবং দুলাভাই চিটাগাং থেকে আমাদের বাসায় আসেন এবং বর্তমানে তারাও আমাদের সাথে হোম কোয়ারেন্টাইন পালন করছে।
আমাদের এই বিপদের সময় দয়া করে আমার পরিবার সম্পর্কে মিথ্যা রিপোর্ট করবেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যরা সুস্থ আছে। কারো মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা দেয়নি। আমার ছোট ভাই এবং ড্রাইভার অসুস্থ বোধ করায় কভিড-১৯ টেস্ট করানো হয়েছে যার ফল নেগেটিভ এসেছে। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করেন এবং হেফাজত করেন বাংলাদেশের সবাইকে আমিন’’..