২২ মার্চ ২০২০, ১২:৪৩

আজ লাইলাতুল মেরাজ: ঘটনা ও শিক্ষা

  © ফাইল ফটো

আজ লাইলাতুল মেরাজ। হিজরি ২৬ রজব দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৭ রজব পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ বা শবে মেরাজ। মেরাজ মহানবী (সা.)-এর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজিজা বা অলৌকিক কীর্তি। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অন্য কোনো নবী বা রাসূল এই পরম সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে কাছে ডেকে নিয়ে মুসলমানদের ওপর ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত (নামাজ) ফরজ করে দেন।
লাইলাতুল মেরাজ ভারতীয় উপমহাদেশে শবে মেরাজ হিসেবে বেশি পরিচিত। শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ- শবে ফারসি শব্দ। যার অর্থ হলো রাত, রাত্রি বা রজনী। আবার ‘লাইলাতুল’ আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো রাত বা রজনী এবং মেরাজ আরবি শব্দ। মেরাজ শব্দটি আরাজা থেকে গৃহীত, যার অর্থ সে আরোহণ করেছিল। মেরাজের অর্থ উর্ধ্বগমন বা উর্ধ্ব গমনের বড় মাধ্যম।শবে মেরাজ শব্দ দুটির সম্মিলিত শাব্দিক অর্থ হলো- উর্ধ্বগমনের রাত বা রজনী।
ইসলামি পরিভাষায় রাসূল (সা.) যে রাতে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় তার ডাকে সাড়া দিয়ে উর্ধ্ব আকাশে গমন করেছিলেন সেই রাত ও সেই পবিত্র অভিযাত্রাকে শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজ বলা হয়। মেরাজের প্রেক্ষাপট হিসেবে বলা হয়ে থাকে, মেরাজ সংঘটিত হবার বছরে নবীজি (সা.)-এর চাচা আবু তালেব ও সহধর্মিণী হযরত খাদিজা (রা.) অল্পদিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন।
এ বছরকে নবীজি (সা.)-এর জীবনে ‘আমুল হুজন’ বা দুঃখের বছর বলা হয়। রাসুল (সা.)-এর দুঃখ নিবারণ, শান্তনা দেবার নিমিত্তে ও ইসলামের দাওয়াতি কাজে উদ্বুদ্ধকরণে আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দাকে মেরাজের রাতে কাছে ডেকে সম্মানিত করেন।
মেরাজ যে সংঘটিত হয়েছিল তা কুরআন হাদীসের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু কোন রাতে সংঘটিত হয়েছিল তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। নবির জীবনী ও ঐতিহাসিক বর্ণনার কোথাও নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত সূত্রে মেরাজের তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। যা আছে তা খুবই মতবিরোধপূর্ণ। মেরাজ নিয়ে সিরাত গবেষক ও ঐতিহাসিকদের ষোলটি মতামত পাওয়া যায়।
কতিপয় ঐতিহাসিকদের মতে, প্রিয় নবি (সা.)-এর নবুয়তের একাদশ (৬২০ খ্রিস্টাব্দ) বছরে ২৭ রজবের রাতে মিরাজ সংঘটিত হয়। তখন নবীজি (সা.)-এর বয়স ছিল ৫১ বছর। একরাতে মহানবী (সা.) হাতিমে কাবায় শুয়েছিলেন। কারো মতে, উম্মে হানীর ঘরে শায়িত ও নিদ্রিত ছিলেন। বুখারী শরীফের এক বর্ণনানুযায়ী তিনি নিজ ঘরে শুয়েছিলেন। জিব্রাইল (আ.) সেখানে এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, ওজু করালেন, সিনা চাক করলেন।
অতঃপর বুরাক নামীয় বিশেষ বাহনে আরোহণের মাধ্যমে পবিত্র এ শোভাযাত্রার সূচনা হয়। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসায় গমন করেন এবং সেখানে তিনি সমস্ত নবীদের ইমাম হয়ে জামাতে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে প্রিয়নবি (সা.) হয়ে ওঠেন ইমামুল মুরসালিনা ওয়ান নাবিয়্যিন।
অতঃপর তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বোরাক বাহনে আসীন হয়ে উর্ধ্বলোকে গমন করেন। মেরাজের সফরে আমাদের নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বিভিন্ন নবী–রাসুলের বিশেষ সাক্ষাৎ হয়। প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহিম (আ.)–এর সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময় হয়।
তিনি কাবার ঠিক উপরে সপ্তম আসমানে অবস্থিত ফেরেশতাদের কিবলা বাইতুল মামুর গেলেন। উল্লেখ্য যে, এ বায়তুল মামুরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করেন। যারা একদিন তাওয়াফ করেছেন তাদের আর কেয়ামত পর্যন্ত তাওয়াফ করার সুযোগ থাকে না।
অতঃপর সিদরাতুল মুন্তাহার (এক বড় প্রকাণ্ড কূল বৃক্ষবিশেষ) নিকটে যান। জিবরাইল নবি (সা.) বললেন, এই বৃক্ষটির নাম সিদরাতুল মুনতাহা। যেখানে চারটি প্রবাহমান নদী। দুইটি ভিতরের দিকে প্রবাহিত এবং দুইটি বাইরের দিকে। ভিতরের দুইটি বেহেশতে প্রবাহমান
সালসাবিল ও কাওসার নামক দুইটি নদী। আর বাহিরের দিকে প্রবাহমান দুইটি হলো ভূ-পৃষ্ঠের মিসরে প্রবাহিত নীল ও ইরাকে প্রবাহিত ফোরাত নদী বা তাদের নামের মূল উৎস। সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত গমনান্তে সেখান থেকে নবি (সা.) একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিমে পৌঁছেন। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাঈল (আ.) ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী। আল্লাহ তায়ালা সিদরাতুল মুনতাহা থেকে উর্দ্ধ জগতে যতটুকু চেয়েছেন ততটুকু পর্যন্ত তাঁর প্রিয় হাবিবকে কাছে টেনে নিয়েছেন।
এখানে তিনি শুধু একটি পর্দার অন্তরাল থেকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘অতঃপর তিনি নিকটে এসেছেন এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছেন। এমনকি দুই ধনুকের মত নিকটবর্তী হয়েছেন, এমনকি আরও অধিকতর নিকটবর্তী হয়েছেন। (সুরা নজম, আয়াত ৮ - ৯)।
সেখানে প্রিয়নবি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন। যেমনটি কুরআনে এসেছে, ‘তিনি যা দেখেছেন অন্তর তাকে অস্বীকার করেনি। (সুরা নজম, আয়াত- ১১)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাঁর দৃষ্টি বক্র হয়নি এবং লক্ষচ্যুত হয়নি।’ (সুরা নজম, আয়াত- ১৭)।
নামাজে যে তাশাহহুদ পড়া হয় তাই ছিল আল্লাহর সঙ্গে প্রিয়নবির ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। সেখানের ভাব বিনিময় হলো-আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি, ওয়াস সালাওয়াতু, ওয়াত-তাইয়্যিবাতু, আস সালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ, আস সালামু আলাইনি, ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন। আশহাদু আল লাইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভ ও সরাসরি কথোপকথন শেষে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়। অতঃপর প্রিয়নবি দুনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ফেরার পথে পথিমধ্যে ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এবং প্রাপ্তির বিষয়ে কথোপকথনে প্রিয়নবী (সা.) পুনরায় আল্লাহর সাক্ষাতে যান এবং ৫০ ওয়াক্ত নামাজ থেকে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত নির্ধারিণ করেন। যারা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তাদের আমল নামায় ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সাওয়াব দান করবেন। তাই নামাজকে বলা হয় মুমিনের মেরাজ।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদেশ, জান্নাত–জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। মিরাজের প্রথম অংশ তথা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু নবী করিম (সা.)–এর মিরাজ রাত্রিকালেই হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। মিরাজ রজনীকে আরবিতে ‘লাইলাতুল মিরাজ’ এবং ‘লাইলাতুল ইসরা’ও বলা হয়।
আর মসজিদে আকসা থেকে আসমান পর্যন্ত যে সফর তাই মিরাজ। মেরাজের ঘটনা পবিত্র কোরআনের সুরা নাজমে ও সুরা বনি ইসরাইলে বিবৃত হয়েছে। মিরাজের ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়ায় সুরা বনি ইসরাইলের আরেক নাম হলো সুরা ইসরা। হাদিস শরিফেও বুখারি ও মুসলিম সিহাহ সিত্তার সব হাদিসসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে এই ইসরা ও মিরাজের বিষয়টির বিবরণ রয়েছে।
কুরআন শরিফের সুরা বনি ইসরাইলের প্রথম আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ ( সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত -১)।
শবে মিরাজের উপহার সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মিরাজের রাতে নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস দান করা হয়—প্রথমত: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; যা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত: তাঁর উম্মতের যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কারও শরিক করবে না, আল্লাহ তার পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তৃতীয়ত: সূরা আল-বাকারার শেষ অংশ।
চতুর্থত: সূরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশ। যথা- ১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কারও শরিক না করা, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করা, ৩. আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মুসাফিরের হক মেনে চলা, ৪. অপচয় না করা, ৫. অভাবগ্রস্ত ও প্রার্থীকে বঞ্চিত না করা, ৬. হাতকে গুটিয়ে না রেখে সব সময় কিছু দান করা, ৭. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা, ৮. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা, ৯. ব্যভিচারের নিকটবর্তীও না হওয়া, ১০. এতিমের সম্পদের ধারে-কাছেও না যাওয়া, ১১. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তা অনুসন্ধান করা, ১২. মেপে দেওয়ার সময় সঠিক ওজন পরিমাপ করা, ১৩. প্রতিশ্রুতি পালন করা, ১৪. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা না করা। এসব দিকনির্দেশনা মেনে চললে ইহজীবন ও পারকালীন জীবনে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে। এই ১৪ দফা সুরা বনি ইসরাইলের ২২-৪৪ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে।
মেরাজের ঘটনাকে অনেকে অবিশ্বাস করেন। যে আল্লাহ পাক মুসা (আ.)-কে সাগরের বুক চিড়ে রাস্তা করে দিতে পারেন, হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা করতে পারেন, হযরত ইসা (আ.)-কে পিতা ছাড়া হযরত মরিয়মের গর্ভে জন্ম দিতে পারেন সেই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে মেরাজ ঘটনা তো অতি সাধারণ ব্যাপার। প্রিয়নবী মেরাজ থেকে ফিরে মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করলে মক্কার অবিশ্বাসী কাফেররা মেরাজের ঘটনাকে অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। কিন্তু বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করেন হযরত আবু বকর (রা.)। যার ফলে তিনি হলেন সিদ্দিকে আকবর।
মেরাজকে উপলক্ষ্য করে কুরআন ও হাদিসে কোনো নফল রোজা ইবাদতের কথা বলা হয়নি। এমনকি মহানবি (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় মেরাজকে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করেনি। মেরাজ ছিল অন্য দু’চারটি রজনীর মতো। তিনি অন্য রজনী যেভাবে অতিবাহিত করতেন মেরাজের রজনীও অনুরুপ ছিল।
বরং মহানবী (সা.) রজব মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এই দোয়া করতেন-‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শা’বান, ওয়া বাল্লিগনা রামাযান’ অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে রজব-শা’বানে বরকত দান করুন এবং এ বরকত সাথে নিয়ে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা ধারণ করে আমরা যেন ইহজীবন ও পরকালীন জীবনে কামিয়াবী অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক