আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিন-হোম কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন কী?
সারাবিশ্বে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাস করোনার কারণে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। প্রাণ হন্তারক এই ভাইরাসের সঙ্গে বেশ কয়েকটি পরিভাষা আলোচিত হচ্ছে। যেমন আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, হোম কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
আইসোলেশন
আইসোলেশনের অনেক অর্থ থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষিতে আক্রান্ত রোগীকে আলাদা ব্যবস্থায় রেখে চিকিৎসা করাকে আইসোলেশন বলে। ‘The complete separation from others of a person suffering from contagious or infectious disease.’ কারো শরীরে করোনার লক্ষণ প্রকাশ পেলে, সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ হলে, মূল কথা করোনার উপসর্গ হয়েছে তা ধরা পড়লে তাকে আইসোলেশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আইসোলেশনের সময় চিকিৎসক ও নার্সদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালে থাকতে হয় রোগীকে। অন্য রোগীদের কথা ভেবে হাসপাতালে আলাদা জায়গা তৈরি করা হয় এসব রোগীদের জন্য। অন্তত ১৪ দিনের মেয়াদে আইসোলেশন চলে। অসুখের গতিপ্রকৃতি দেখে তা বাড়ানোও হতে পারে। আইসোলেশনে থাকা রোগীর সঙ্গে বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। তাদের পরিবার পরিজনের সঙ্গেও এই সময় দেখা করতে দেওয়া হয় না। জরুরী প্রয়োজনে দেখা করতে দেওয়া হলেও অনেক বিধিনিষেধ মেনে অনুমতি মিলে।
বাংলাদেশের সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজধানীর বড় ও মাঝারি ধরনের হাসপাতালগুলোকে ৫ থেকে ১০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড করতে বলা হয়েছে। যেই ওয়ার্ডটি হবে হাসপাতালের একপাশে। প্রতিটি শয্যার দূরত্ব হবে কমপক্ষে ১ মিটার। সেখানে যারা সেবা প্রদান করবেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি হাসপাতালের অন্য রোগীরা যেন তাদের সংস্পর্শে আসতে না পারে সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
যেহেতু করোনা অসুখের কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি, তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে এই সময় কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দিয়ে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায় এমন কিছু ওষুধ ও পথ্য দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। যাদের শরীরে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ও করোনার প্রকোপ অল্প, তারা এই পদ্ধতিতে সুস্থও হন। যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ও রোগের হানা বড়সড় রকমের, তাদের পক্ষে সেরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
কোয়ারেন্টিন
কোয়ারেন্টিন মানে সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তির চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করা। কোয়ারেন্টিন তাদের জন্যই প্রযোজ্য, যারা রোগে আক্রান্ত হননি কিন্তু রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন। রোগের প্রাদুর্ভাবযুক্ত এলাকায় থেকেছেন। অর্থাৎ যাঁরা রোগ ছড়াতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। করোনার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার পরেই তার উপসর্গ দেখা দেয় না। অন্তত সপ্তাহখানেক সে সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
তাই কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে ঘুরে এলে বা রোগীর সংস্পর্শে এলে তার শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে কোভিড-১৯। বাসা আদৌ বেঁধেছে কি না বা সে আক্রান্ত কি না এটা বুঝে নিতেই কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয় রোগীকে। অন্য রোগীদের কথা ভেবেই কোয়ারেন্টিন কখনো হাসপাতালে আয়োজন করা হয় না। করোনা হতে পারে এমন ব্যক্তিকে সরকারি কোয়ারেন্টিন পয়েন্টে রাখা হয়। কমপক্ষে ১৪ দিনের সময়সীমা এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কোয়ারেন্টিন শব্দটি এসেছে ‘কোয়ারান্টাগাইরন’ থেকে, যার অর্থ ফরটি ডে বা ৪০ দিন। প্লেগের সময় জাহাজের মাল খালাস করার আগে ৪০ দিন তীরে ভিড়ে থাকতে হতো। (A period, originally 40 days, of detention or isolation imposed upon ships, persons, animals, or plants on arrival at a port or place, when suspected of carrying some infectious or contagious disease.)
সম্প্রতি চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের কারণে কোয়ারেন্টিনের আগে কুষ্ঠ রোগ, পীতজ্বর বা ইয়েলো ফিভার, কলেরার মতো রোগের বিস্তার ঠেকানোর জন্য কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এই সময় রোগের আশঙ্কা থাকে শুধু, তাই কোনও রকম ওষুধপত্র দেওয়া হয় না। শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হয়। বাইরে বের না হতে পরামর্শ দেওয়া হয়। যেহেতু রোগের জীবাণু ভিতরে থাকতেও পারে, তাই মাস্ক ব্যবহার করতেও বলা হয়। বাড়ির লোকেদেরও এই সময় রোগীর সঙ্গে কম যোগাযোগ রাখতে বলা হয়।
কুইবেক অর্থ ইয়েলো বা হলুদ। হলুদ রঙের পতাকা তাই একসময় কোয়ারেন্টিন বোঝাত। সবুজ, কালো বা হলুদ-কালোর সংমিশ্রণ কোয়ারেন্টিন বোঝাতে সবই ব্যবহার হয়েছে।
হোম কোয়ারেন্টিন
হোম কোয়ারেন্টিন মানে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি নিজ বাড়িতে স্বেচ্ছায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোয়ারেন্টিনে থাকবেন এবং এ সময় নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। হোম কোয়ারেন্টিনকে অনেকে হোম আইসোলেশন বলে থাকেন। আইসোলেশন বাড়িতে রেখে সম্ভবও নয়। বরং একে হোম কোয়ারেন্টিন বলাটাই অনেক যুক্তিযুক্ত।
কোনো ব্যক্তি যখন নিজের বাড়িতেই কোয়ারেন্টিনের সব নিয়ম মেনে বাইরের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা বন্ধ করে আলাদা থাকেন, তখন তাকে হোম কোয়ারেন্টিন বলে। কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে ঘুরে এলে বা রোগীর সংস্পর্শে এলে তার শরীরেও বাসা বাঁধতে পারে কোভিড-১৯। বাসা আদৌ বেঁধেছে কি না বা সে আক্রান্ত কি না এটা বুঝে নিতেই এই ব্যবস্থা নিতে হয়। এক্ষেত্রেও ন্যূনতম ১৪ দিন ধরে আলাদা থাকার কথা। পুরো বাংলাদেশে এখন ৫০০০’র বেশি মানুষকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে।
লকডাউন
যে জনপদ বা অঞ্চলে কারো প্রবেশ ও প্রস্থান নিষিদ্ধ এটি লকডাউন নামে পরিচিত। উইকিপিডিয়া অনুসারে লকডাউন হলো, ‘A lockdown is an emergency protocol that usually prevents people or information from leaving an area. The protocol can usually only be initiated by someone in a position of authority.’
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না এবং সেখান থেকে কেউ বেরও হতে পারবেন না বলে আজ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটিকে লকডাউন বলা যায়। এসময় শিবচর উপজেলায় শুধু ঔষধের দোকান এবং অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকবে। এছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ থাকবে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক