করোনায় দেশের অর্থনীতি ও কোয়ারেন্টাইনে
গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির পর ক্রমেই বাড়তে থাকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। এতে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যাও। বাড়তে থাকে বিশ্বব্যাপি উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সংক্রামক এই ভাইরাসের তোপ কতখানি হতে পারে তখন সেটা আন্দাজ করা না গেলেও এর প্রভাবে এখন ধুকছে সারা বিশ্বের মানুষ। করোনার প্রভাবে যে শুধু মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বা প্রাণহানি হচ্ছে তা কিন্তু নয়, থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও।
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৬২ টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার ৬৬৯ জন মানুষ। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে সাত হাজার ৪৬৭ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৮০ হাজার ৩২৯ জন।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর হঠাৎ করেই সব কিছু বদলে গেছে। জনবহুল রাজধানী ঢাকা অনেকটা থমকে গেছে। জনকোলাহল এড়িয়ে মানুষের মাঝে এখন ভয় আর উদ্বেগ। তাকিয়ে আছে তারা সরকারের দিকে। আর সরকারও এখানে নিস্তেজ। ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যত অসহায় বিশ্ব রাজনীতিকরাও।
ইতালিতে ভাইরাসের ব্যাপক প্রভাব পড়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইউরোপের দেশ গুলোর সাথে বিমান যোগাযোগ (যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া) । পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথেও যোগাযোগ অনেকটা বিছিন্ন। চীনে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় চীন থেকেও বন্ধ আছে আমদানি।
এমন অবস্থায় বলতে গেলে বাংলাদেশ ক্রমেই পৃথিবী থেকে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য দেশও এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। শঙ্কার জায়গা হলো এখনো বলা যাচ্ছে না এ অবস্থা কতদিন চলবে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে খেলার মাঠেও। দেশের ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক সকল খেলা স্থগিত করতে হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজারেও আতঙ্কের ছায়া। সারা দেশের সকল সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারন মানুষ থেকে নীতি নির্ধারকরা সকলেই উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে।
করোনাভাইরাস পুঁজিবাজারেও আঘাত হেনেছে। এতদিন চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও দেশের পুঁজিবাজারে তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে গত আট মার্চ দেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে পুঁজিবাজারে আতঙ্ক বাড়ে। আর এ আতঙ্কের কারণে পুঁজিবাজারেও বড় ধরনের দরপতন হয়, যাতে মূল্যসূচক ও লেনদেনে প্রভাব পড়ে। তবে আস্তে আস্তে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং পুঁজিবাজারেরও নাজেহাল অবস্থা হচ্ছে। বন্ধ রয়েছে বৈশ্বিক আমদানি রপ্তানিও। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে মানুষের পাশাপাশি করোনার ভয়ে দেশের অর্থনীতিকেও বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হচ্ছে।
এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, করোনাভাইরাস সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ দিকে গেলে বাংলাদেশ ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবাখাতে। আগামী ১ বছরে কমে যেতে পারে দেশের প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারির জের ধরে শিগগিরই বিশ্ব অর্থনীতিতে ঘনিয়ে আসতে পারে বড় ধরণের বিপর্যয়। শুরু হতে পারে ভয়াবহ মন্দা। বাংলাদেশকে এবার বড়সড় অর্থনৈতিক ধাক্কার মুখে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় এমনিতেই পড়তির দিকে। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কমেছে চার দশমিক সাত নয় ভাগ। অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানিও। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এই পণ্যটির প্রধান বাজার। করোনা ভাইরাসের কারণে সেখানকার বাজারে এরই মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতালিতে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। যেখানে ১৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ গত বছর। ধীরে ধীরে একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গোটা ইউরোপে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২ ভাগ আসে ইউরোপ থেকে আর ১৮ ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকই নিম্নমুখী। তার মধ্যেও ভাল করছিল রেমিট্যান্স। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১০৪২ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ ভাগ বেশি। এই মহামারি অবস্থা চলতে থাকলে এই গতি ধরে রাখা এখন কঠিন হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্যে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকা শক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের চাকরি চলে যাওয়ার মতো উপক্রম হবে। অন্যদিকে প্রবাসীরা টাকা পাঠানো কমিয়ে দিলে তাদের পরিবার দেশে আগের মত খরচ করতে পারবেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। কমে যাবে বেচাকেনা, চাহিদা কমে গেলে ভোক্তা পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। আবার বেড়ে যাবে আমদানিকৃত পণ্যের দাম। সবমিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতার আশঙ্কাও ধারণা করা যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে চলতি বছরেরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাংলাদেশের জন্যে।