‘ভাত দে হারামজাদা’— কবির মৃত্যু দিবস ও কবিতার প্রভাব
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২০, ০৪:৪৮ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৫৫ PM
বাংলা সাহিত্যে প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত রফিক আজাদ। সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার জন্য। যে কবিতাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় আসা সর্বাধিক কবিতার একটি। একই সঙ্গে এদেশের লাখ লাখ বেকার তরুণ তরুণীদের ক্ষোভ প্রকাশেরও অন্যতম কবিতা। রফিক আজাদ স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় এই কবিতাটি রচনা করেন, যা বাংলার গণমানুষের মুখেমুখে সেই সময় উচ্চারিত হয়েছিল।
‘ভীষণ ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শরীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে- প্রতিপলে- সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি- যেমন চৈত্রের শষ্যক্ষেত্রে- জ্বেলে দ্যায়
প্রভুত দাহন- তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ’
‘আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো।’
কবি রফিক আজাদের কবিতাগুলোর মধ্যে এই 'ভাত দে হারামজাদা' বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। কবির মৃত্যুর পর অনেকে তাকে বলছেন ‘ভাত দে হারামজাদা’ খ্যাত কবি। কেউ কেউ বলেছেন 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। যদিও তাঁকে ভালোবাসার কবি বলতে অনেকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।‘ভালোবাসা মানে এঁকে অপরেরে প্রতি খুব করে ঝুঁকে থাকা.. ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালার সামনে অবিরল কথা বলা’ (কবিতা: ভালোবাসার সংজ্ঞা)।‘যদি ভালবাসা পাই শীতের রাতের শেষে / মখমল দিন পাব / যদি ভালবাসা পাই পাহাড় ডিঙ্গাবো / আর সমুদ্র সাঁতরাবো’ (কবিতা: যদি ভালবাসা পাই )। তিনি লিখেছিলেন ‘একটি চুমুর বিনিময়ে একটি কবিতা উৎসর্গ হবে’।
রফিক আজাদ ১৯৪২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার গুণী গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।রফিক আজাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । তিনি ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত। রফিক আজাদ বিভিন্ন সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা করেছেন এবং জীবিকাসূত্রে সরকারি চাকুরিও করেছেন।। ২০১৩ সালে তিনি সাহিত্যে একুশে পদক লাভ করেন।২০১৬ সালের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৮ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর এই প্রথিতযশা কবি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রতিবাদী এই কবি সাধারণ পাঠকের কাছে ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার জন্য পরিচিত পেলেও চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’র কবিতাও তাঁর সমান জনপ্রিয়।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে — ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘সশস্ত্র সুন্দর’, ‘এক জীবনে, ভালোবাসার কবিতা’।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে চক্রান্তকারীদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল দুর্ভিক্ষ। আর সেই দুর্ভিক্ষের সময় কবি প্রকাশ করলেন এই ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতা। এক অজানা কারণে তখন চারিদিকে পাঠ হতে লাগল এই কবিতা। কবি নিজেও খুব গর্বভরে পাঠ ও প্রচার করতেন ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি।ভাত দে হারামজাদা কবিতার প্রেক্ষাপট ও পরবর্তীতে এ কবিতার প্রভাব নিয়ে কবির মৃতুতে লিখেছিলেন তাঁর রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী।
তিনি লিখেন,‘একদিন এক রাজনৈতিক সভা করে দুপুরে কাঞ্চনপুর হয়ে ফিরছিলাম। সঙ্গে ৩-৪টা গাড়ি। কোথাও গেলে এখনো রাস্তার দুই পাশে কখনো বেশি কখনো কম লোকজন দাঁড়ায়। সেদিন এক বাড়ির দেউড়ি বেড়ায় কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা ছোট্ট উদাম বেশ নাদুসনুদুস বাচ্চা তার মাকে ঠেলা দিচ্ছিল, ‘ওই মা, মা, ভাত দিলি না? পেটে যে আগুন ধরছে। পুইড়া গেল। মা ভাত দে।’ বাচ্চার আপন মনে মায়ের কাপড় টেনে বারবার বলা কথা আমার কানে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছিল ’৭৩ এ কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতার কথা। তখন সারা দেশে এক অস্থিতিশীল অবস্থা। পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের কাছে নিদারুণভাবে হেরেছিল। ... যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অভাব তো ছিলই, পাটের গুদামে আগুন, কলকারখানা ধ্বংস, আওয়ামী লীগ নেতাদের গুপ্তহত্যা- এর মধ্যে কবি রফিক আজাদ একদিন লিখে বসলেন ‘ভাত দে হারামজাদা’। তখন বাংলাদেশ বেতার আর বিটিভি ছাড়া তেমন প্রচার মাধ্যম ছিল না। পত্রিকা ছিল বেশ কয়েকটি। পত্রিকাতে ফলাও করে ছাপা হয়, বিবিসি প্রচার করে এসব দেখেশুনে আমিও কিছুটা কষ্ট পাচ্ছিলাম। স্বাধীনতার পর কবি রফিক আজাদ আমার প্রাণ ছুঁয়ে ছিলেন।
রফিক আজাদ মুক্তিযুদ্ধের কবি, স্বাধীনতার কবি, খেটে খাওয়া মানুষের ভালোবাসার কবি। তিনি রণাঙ্গনে যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি রাইফেলও ধরেছেন। আমি তাকে অস্ত্র ধরা শিখিয়েছি। তাই বুকের মধ্যে তার জায়গা ছিল অনেক। ‘ভাত দে হারামজাদা’ লেখার জন্য কবি রফিক আজাদের জেল হয়েছে, হুলিয়া জারি হয়েছে। এক সকালে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে দু’পা জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে বলেন, ‘স্যার আমারে বাঁচান। আমার যে জেল হয়ে গেছে। জেলখানা আমার ভালো লাগবে না। আমি কবি মানুষ জেলখানায় বসে বসে কী করব?’
কাদের সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘রফিক আজাদ কখনো আস্তে কথা বলতে পারত না। তার কথা দূর থেকে শোনা যেত। মা রফিক আজাদকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। বাবর রোডের ছোট্ট বাড়ি, কবি রফিক আজাদের কণ্ঠস্বর তার কানে যেতে সময় লাগেনি। বৈঠকখানায় এসে রফিক আজাদকে আমার পা ধরে থাকতে দেখে নিজ হাতে কবিকে টেনে তুলে শোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে? তোমার মুক্তিযুদ্ধের গুরু, তার কাছে কোনো কিছু বলতে হলে পা ধরতে হবে কেন? তুমি তার যোদ্ধা। তোমায় ছায়া দেওয়া তার দায়িত্ব। কোনো চিন্তা করো না। যে জন্য এসেছ শান্তভাবে বল। বজ্রের যা করার অবশ্যই করবে। কিন্তু তুমি বাবা বঙ্গবন্ধুকে এভাবে হারামজাদা বলতে গেলে কেন? এটা কিন্তু বাবা ভালো করোনি।’ মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাস্তা খেয়েছো?’ না সূচক উত্তর পেয়ে বললেন, হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নাও। যতক্ষণ এখানে আছো চিন্তার কিছু নেই। ঝাড়া দিয়ে কবি উঠলেন অনেকটা বিপ্লবী কবি কাজী নজরুলের মতো বাবরি দুলিয়ে। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেলেন। মনে হলো বেশ কিছুদিন শান্তি মতো খাবার খাননি... কবির নাস্তা খাওয়া শেষ হলে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিই আপনি বঙ্গবন্ধুকে এত বড় গালি দিলেন? আমাকেও কি দিতে পারবেন?’ মনে হয় কবি যেন জ্বলে উঠলেন। জ্বলবারই কথা, পেটে দানা-পানি পড়লে, নিজেকে নিরাপদ বোধ করলে তখন আর কবিদের হীনম্মন্যতা থাকে না। স্বরূপে তারা বেরিয়ে আসে। কবি বললেন, কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গালি দিলাম? আমি শুধু আমার ক্ষুধার জ্বালার কথা বলেছি, মানুষের কথা বলেছি। গ্রামগঞ্জের বাচ্চারা মায়ের কাছে কীভাবে খাবার চায়। খুব ক্ষুধা লাগলে বলে না, মাগো ভাত দে, ভাত দিলি না, ভাত না দিলে তোরে খামু কিন্তু, বলে না?’ আঁতকে উঠে সম্বিত ফিরে পেলাম। সত্যিই তো কত জায়গায় কত বাচ্চার অমন কথা শুনেছি। আইয়ুব-মোনায়েমের আমলে বাবা-বড় ভাই যখন জেলে আমাদের পরিবার ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় আমি আমার ছোট ভাই বোনেরা কতবার মার কাছে অমন করে কান্নাকাটি করেছি, চিৎকার করেছি।’
কাদের সিদ্দিকীর ভাষায়, ‘কবি ৩-৪ বার ‘ভাত দে হারামজাদা’ পড়ে শুনালেন। ...কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’ শুনে আমি উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কবি তো মোটেই সরকারকে গালি দেয়নি, বঙ্গবন্ধুকে তো নয়ই। বরং বঙ্গবন্ধুকে কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে যাওয়া থেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। উত্তেজনায় ঘেমে যাচ্ছিলাম। আমি সাধারণত অমন উত্তেজনাবোধ করি না। হানাদারদের মুখোমুখি হয়েও করিনি। সময় কাটতে চাচ্ছিল না। কবিকে বাড়িতে রেখে বিকালে গণভবন সুগন্ধায় গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বলছিলেন, ‘কি রে কাদের! তোর কবি রফিক আজাদ আমাকে অমন গালাগাল করছে কেন? সত্যিই কি আমি অমন কাজ করছি?’ বঙ্গবন্ধুর কথায় আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। কতটা আঘাত পেলে কেউ অমন বলে। আমি বললাম, না। কবি আপনাকে গালাগাল করেনি। আপনাকে যথার্থ পিতার জায়গা দিয়ে বিপদ থেকে সতর্ক করতে চেয়েছে। ‘কী বলিস? অমনভাবে এই দুঃসময়ে আমাকে উদ্দেশ করে ভাত দে হারামজাদা বললো। তারপরও তুই বলছিস ও খারাপ বলেনি। কী বলিস?’
‘কবি আমায় যেভাবে যা বুঝিয়েছিলেন আমিও নেতাকে সেভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এখন খেয়াল নেই হয় মোহাম্মদ আলী, না হয় ফরাসউদ্দিন কেউ একজন ছিলেন। কবিতাটি আনতে বললেন। আমি ২-৩টি জায়গা কয়েকবার পড়ে শুনালাম। পিতা তার আসন থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘ঠিকই তো, তোর কবি ঠিক বলেছে, ঠিক লিখেছে। ওকে এখনই নিয়ে আয়।’ কবি আমার বাসাতেই ছিল। তাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নেওয়া কোনো কঠিন ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই তাকে নিয়ে গেলাম পিতার কাছে। গিয়ে সালাম করার সঙ্গে সঙ্গে মাথার চুল ধরে টেনে তুলতে গিয়ে পিতা বললেন, ‘এই হারামজাদা, কবি হলেই এমন লেখে?’ কবি রফিক আজাদ বেশ মুখোর ছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এই যে আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুলতে হারামজাদা বললেন, এটা কী? এটা কি ক্ষুুব্ধ হয়ে, নাকি ভালোবেসে বলেছেন?’ বঙ্গবন্ধু তব্দা ধরে বসে পড়লেন। কবি তার ‘ভাত দে হারামজাদা’ শুনালো ৪-৫ বার। পিতা অভিভূত হলেন। বুকে নিয়ে বারবার আদর করে বললেন, ‘তুই আরও লিখবি। এটাই তো কবিতা। মানুষের কথা তোরা না বললে কে বলবে?’ আমাকে বললেন, ‘কাদের, ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসবি। ও আমাকে কবিতা শুনাবে। কবিতা শুনলে মন পরিষ্কার হয়।’ সঙ্গে সঙ্গে মনসুর ভাই, না মালেক ভাই কে যেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, বললেন ‘ওর মামলা আমি তুলে নিলাম। আমি বেঁচে থাকতে ওর নামে যেন কোনো মামলা না হয়।’ এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর এই লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে ১৭ এপ্রিল।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক