এক দেশে চার প্রেসিডেন্ট

  © ফাইল ফটো

আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব ইউরোপের একটি দেশ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে ।যে দেশটি গত শতাব্দীর শেষে নব্বইয়ের দশকে বসনীয় মুসলিম হত্যা ও নির্যাতনের পর ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে। দেশটিতে জটিল রাজনৈতিক পদ্ধতির কারণে এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বসনিয়া হার্জেগোভিনা বর্তমানে একই সঙ্গে চার জন প্রেসিডেন্ট দ্বারা পরিচালিত।

ইউরোপ মহাদেশের বলকান অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে ক্রোয়েশিয়া, পূর্বে সার্বিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে মেসিডোনিয়া, দক্ষিণে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর।বলকান উপদ্বীপে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ত্রিভুজ আকৃতির। বসনিয়া অঞ্চলটি উত্তরে পাহাড় ও গভীর বনবেষ্টিত। বিশাল এলাকাজুড়ে অমসৃণ ও সমতল কৃষিভূমির হার্জেগোভিনা অঞ্চলটি দক্ষিণে এর সংকীর্ণ উপকূল।

দেশটির আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার (১৯৭৪১ বর্গ মাইল)।লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ দুই হাজার ৬৩৬ জন। ইউরোপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বিরল। তুরস্কের পরে ইউরোপে বসনিয়াই একমাত্র দেশ যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।ইউরোপের সংখ্যাগরিষ্ঠ কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও সেভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো মিলেনি। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দেশটির প্রায় ৪৩ শতাংশ জনগণ মুসলমান এছাড়া বসনীয় সার্ব ৩৩% এবং বসনীয় ক্রোট ১৭%।এর রাজধানীর নাম সারায়েভো। দেশটির মুদ্রার নাম মার্কা।বসনিয়া দেশটিতে তিনটি প্রধান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। বসনীয় মুসলমান বা বসনিয়াক, ক্রোট ও সার্ব। তিনটি গোষ্ঠী নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। তাই বলতে হয়, বসনিয়ায় আছে তিনটি প্রধান ভাষা। অতীতে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা
যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্রের একটি অংশ ছিল।

১৯৯২ সালের মার্চ মাসে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাচীনকালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে বলা হতো ইলিরিকাম। পূর্ব ইউরোপের জাতি সার্বরা সপ্তম শতাব্দীতে ওই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বসনিয়া হাঙ্গেরির কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং পরের ২৬০ বছরের মধ্যে এটি স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৪ শতকে রাজপুত্র শাসিত বসনিয়া দক্ষিণের ডিউক শাসিত হার্জেগোভিনার সাথে মিলে একটি অল্প সময়ের মধ্যযুগীয় রাজ্য গঠন করেছিল। ১৫ শতকের ১৪৬৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ বসনিয়াকে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। ওই সময় অনেক খ্রিষ্টান স্লাব মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হতে থাকে এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের পক্ষে তারা দেশ শাসন করতে থাকে। উসমানীয় সাম্রাজ্যে সঙ্কুচিত হতে থাকলে উনিশ শতকে বলকানের অন্য মুসলিমরা বসনিয়ায় চলে যেতে থাকে।উনিশ শতকের শেষ দিকে ১৮৭৭-১৮৭৮ সালে রাশিয়ার সাথে উসমানীয় সাম্রাজ্যের যুদ্ধের পর ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেস দেশটিকে উসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে অস্টীয়-হাঙ্গেরি রাজ্যের অধীন করে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটি জার্মান ও ইতালিয়ানরা দখল করে নেয়। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর যুগোস্লাভিয়ার ছয়টি অঙ্গ প্রজাতন্ত্রের একটি হয়।

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চায়। ১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটারেরা স্বাধীনতা বেছে নেয়। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নজরদারিতে অনুষ্ঠিত এই গণভোটে দেশটির ৬৪ শতাংশ নাগরিক একটি অবিভক্ত ও স্বাধীন বসনিয়া গড়ার পক্ষে রায় দেন।১৯৯২ সালের ৫ এপ্রিল বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা সংসদ যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।এমন সিদ্ধান্ত নিলেও বসনিয়ার সার্বরা এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করে এবং বেলগ্রেডের সহায়তায় পরদিন ৬ এপ্রিল মুসলমানদের জাতিগত নিধন শুরু করে। মুসলমানেরা সভ্য ইউরোপে এমন হবে, তা ভাবতেও পারেননি। তাই তাদের প্রতিরোধের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। এই নির্মূল অভিযান সভ্য ইউরোপে সাড়ে তিন বছর চলতে থাকে। হাজার হাজার মুসলমান নর-নারী হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় এবং ২০ লাখ মুসলমান দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।৯০-এর দশকে বসনীয় যুদ্ধের একটা অন্ধকার অধ্যায় ছিল যে সংঘাতে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটা সামরিক কৌশল হিসাবে ব্যবহার। বসনিয়ার যুদ্ধ ছিল নব্বইয়ের দশকে সংঘটিত একটি বড় ট্র্যাজেডি। এ যুদ্ধে নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন বসনীয় মুসলমান । মুসলমানদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল সার্বরা। এ যুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণ এমনকি শিশুকন্যাদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বর্বর সার্বরা।বসনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল ও শেষ হয় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। সাড়ে তিন বছরের হত্যাকাণ্ডে মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেক যেন হাওয়া হয়ে যায় ওই হত্যাযজ্ঞে।

ইউরোপের পণ্ডিতরা এ হত্যাযজ্ঞকে বলেন এথনিক কিনজিং বা নৃতাত্ত্বিক পরিছন্নতা! এই শব্দটির সোজা বাংলা করা উচিত গণহত্যা।১৯৯৫ সাল নাগাদ প্রায় ১ লক্ষ লোক মারা যায়, যাদের শতকরা ৮০ ভাগই ছিল বসনিয় মুসলিম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজিদের হাতে ৬০ লাখ ইহুদির মৃত্যুর পর এটাই ছিল গণহত্যার নিকৃষ্টতম উদাহরণ। ১৯৯৫ সালে ডেটনের ওহাই রাজ্যে মার্কিন-মদদে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এতে সার্বিয়ার পক্ষে মেলোসেভিচ, বসনিয়ার পক্ষে ইজেতবেগোভিচ, এবং ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে ফ্রানজো তুজমান উপস্থিত ছিলেন। এই শান্তি আলোচনায় স্থির হয়, একটি বসনিয়া ফেডারেশন গঠন করা হবে, যা একটি ক্রোয়াট-বসনিয়াক ফেডারেশন ও একটি সার্ব প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বিভক্ত থাকবে।স্বাধীন রাষ্ট্র বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার দু’টি প্রধান অঞ্চল রয়েছে মুসলিম ও ক্রোট অধ্যুষিত অঞ্চলটির নাম বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ফেডারেশন আর সার্ব অধ্যুষিত অঞ্চলটি সার্বস্কা রিপাবলিকা। সার্বস্কাকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে রাশিয়া ও সার্বিয়া। বসনিয়া ফেডারেশনে মুসলমান ৭২ শতাংশ এবং সার্ব ৩.৪ শতাংশ, রিপাবলিকায় সার্ব ৮২ শতাংশ ও মুসলমান ১৪ শতাংশ, উভয় স্থান মিলে ক্রোটরা সংখ্যালঘু।

একাধিক প্রেসিডেন্টের দেশ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা অন্য দেশের মতো সেখানে একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন না।তাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ পাঁচ অনুযায়ী, The Constitution of Bosnia and Herzegovina, the Presidency comprises three members: one Bosniak, one Serb, and one Croat।বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট—এই তিন জাতির সমন্বিত প্রেসিডেন্সি পর্ষদ রয়েছে সেখানে। দ্য ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, যেটিতে মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের আধিপত্য বেশি এখান থেকে একজন বসনীয় মুসলিম ও ক্রোটদের একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। অপরটি হচ্ছে সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকা এখান থেকে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই তিনজনের প্রেসিডেন্সি পর্ষদের নেতৃত্বে বা চেয়ারম্যান পদে আট মাস পরপর পর্যায়ক্রমে নতুন একজন আসেন।

প্রেসিডেন্সি পর্ষদে এখন রয়েছেন এসডিএ দলের সেফিক দেজাফেরোভিক(বসনীয়), এস এন এস ডি দলের মিলোরাদ দোদিক(সার্ব) এবং ডি এফ দলের জেলিকো কোমসিক(ক্রোয়েট)। ২০ জুলাই ২০১৯ থেকে এ পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন জেলিকো কোমসিক। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। সরকারের মেয়াদ চার বছর।বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় দুটি স্বতন্ত্র পক্ষ রয়েছে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। দ্য হাউস অব পিপলস এবং দ্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ। হাউস অব পিপলসে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। যার দুই–তৃতীয়াংশ ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকার। অর্থাৎ বসনিয়াক (বসনিয়ার মুসলিম), ক্রোয়েট ও সার্বদের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন এতে। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রয়েছেন ৪২ জন সদস্য। এর দুই-তৃতীয়াংশ ফেডারেশন থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকা থেকে ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।

এর বাইরে দুই অংশের আলাদা প্রেসিডেন্ট, সরকার, সংসদ, পুলিশ ও পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে।সব মিলিয়ে দেশটিতে চারজন প্রেসিডেন্ট, পাঁচটি পার্লামেন্টারি হাউস এবং ১০টি ক্যানটন অ্যাসেম্বলি (শাসনতান্ত্রিক বিভাগ) রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ভোটাররা তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে। ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কথিত দুই স্বতন্ত্র পক্ষের এই সরকার গঠন হয়।সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকার (আরএস) ভোটাররা তাদের একজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি এমপিদের নির্বাচিত করে। এই অংশের রাজধানীর নাম বানজালুকা।আর মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশন তাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের জন্য দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশনের ১০টি ক্যানটনের জন্যও ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ