যে দেশটির প্রেসিডেন্ট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী সুন্নি এবং স্পিকার শিয়া
আজ পৃথিবীর এমন একটি দেশের কথা বলবো যে দেশটির ধর্মীয় সংস্কৃতির চমৎকার সমঝোতার অনুপম চর্চা বিদ্যমান।যার উদাহরণ পৃথিবীর অন্যদেশে বিরল। কারণ দেশটিতে সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলো আনুপাতিক হারে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বর্তমানে যে দেশটিতে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নারী অভিবাসীর সংখ্যা লক্ষাধিক। পৃথিবীর ইতিহাসে যে দেশটি হিজবুল্লাহ ও গৃহযুদ্ধের জন্য ব্যাপকভাবে আলোচিত। ‘‘গতকাল হলো আজকের স্মৃতি আর আজকের স্বপ্ন হলো আগামী’’- এমনও হাজার পংক্তির স্রষ্টা ম্যারোনাইট খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম কবি খলিল জিবরানের মাতৃভূমি লেবানন নিয়ে আজকের আলোচনা। খলিল জিবরান লেবাননের জাতীয় কবি ও তাঁর লিখিত দ্য প্রপেট গ্রন্থ বিশ্বের ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সবার প্রিয় কার্টুন টম এন্ড জেরির নির্মাতারাও মূলত লেবানিজ নাগরিক।
লেবানন এশিয়া মহাদেশের পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। লেবাননের সরকারী নাম লেবানিজ রিপাবলিক। মাউন্ট লেবানন, যা লেবাননের একটি পর্বতমালা, এর গড় উচ্চতা প্রায় ২৫০০ মিটার। দেশটির নাম মূলত এই পর্বতশ্রেণি থেকেই এসেছে।লেবানন দেশটির নাম বিশ্বের সবচেয় প্রাচীনতম দেশের নাম হিসাবে পরিচিত এবং প্রায় ৪০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নামটি অপরিবর্তিত রয়েছে। লেবাননের উত্তর ও পূর্বে সিরিয়া, দক্ষিণে ইসরায়েলের সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও সাইপ্রাস দ্বীপ। লেবানন পৃথিবীর মানচিত্রে এমন অবস্থানে আছে যে, পশ্চিম এশিয়ার জন্য লেবাননকে ইউরোপের প্রবেশদ্বার আর ইউরোপের জন্য একে পশ্চিম এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে অভিহিত করা হয় ।
লেবাননের আবহাওয়ার মধ্যে রয়েছে ভূমধ্যসাগরের ব্যাপক প্রভাব। উপকূলীয় এলাকায় শীতকাল বেশ ঠাণ্ডা ও বৃষ্টিময়। আর গ্রীষ্মকাল গরম ও আর্দ্র। উঁচু স্থানগুলোতে তাপমাত্রা অত্যধিক ঠাণ্ডা, কখনো কখনো সেখানে ভারী তুষারপাতও হয়।লেবাননের বেশির ভাগ স্থানজুড়েই আছে পাহাড়। সামান্য উপকূলীয় অঞ্চল ও বেকা উপত্যকা ছাড়া পাহাড়ের অনুপস্থিতি নেই কোথাও। পাহাড়মুক্ত এ অংশটুকুই লেবানন।লেবাননে মোট ১৫টি নদী রয়েছে। নহর আল লিজানি বড় নদী। এই নদীগুলোর পানি লেবাননের নিজস্ব পাহাড় থেকেই প্রবাহিত হয়।বৈরুত লেবাননের রাজধানী ও প্রধান শহর। সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর এটি।এ শহরে প্রথম জনবসতি গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে। লেবাননের বেসামরিক যুদ্ধের পর থেকে এটি একটি আধুনিক ও পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।লেবাননের ৭৫% আয় আসে পর্যটন খাত থেকে। লেবাননের সরকারী মুদ্রা লেবানিজ পাউন্ড। বাংলাদেশী ১ টাকা সমান প্রায় ১৮ লেবানিজ পাউন্ড।
মধ্যপ্রাচ্যের ছোট্ট দেশ লেবানন। ভূমধ্যসাগরের উপকুলে অবস্থিত দেশটিতে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
লেবাননকে বহু সভ্যতা-সংস্কৃতির মিলন মোহনাও বলা হয়ে থাকে। দেশটির নানা ঐতিহাসিক স্থাপত্য, চোখ জুড়ানো সব সমুদ্রসৈকত, পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর সব পাহাড়-পর্বতের বদৌলতে মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই দেশটি একটি দর্শনীয় স্থান। নানা সময়ে বিভিন্ন সভ্যতার সংস্পর্শে এসে লেবানন সমৃদ্ধ হয়েছে ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতিতে। ক্যানানাইট, ফিনিশীয়, আরব ও ফরাসি সভ্যতার সেসব নিদর্শন আজও দেখা যায় লেবাননের মাটিতে। এটি এমনই এক দেশ, যেখানে সব রুচির মানুষ মুগ্ধ হওয়ার মতো কোনো না কোনো উপাদান পাবেনই। লেবাননে সভ্যতার সূচনা ৭ হাজার বছরেরও আগে। ফিনিয়শীয়দের আদি আবাসভূমি এই দেশ। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪-তে এখানে রোমান সাম্রাজ্যের শাসন শুরু হয়। খ্রিস্টানরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় চলে আসে। এরপর এলাকাটি দখলে নেয় আরব মুসলমানরা। তারপর আসে দ্রুজ নামে নতুন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী।দ্রুজ গোষ্ঠীটি লেবাননে তাদের শাসন কায়েম রাখে কয়েক শতাব্দী । এরপর রোমান ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রণে আসে লেবানন। শেষ পর্যন্ত অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তুরস্ক ভিত্তিক ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৫১৬ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ওসমানীয় শাসকরাই ছিলেন লেবাননের নিয়ন্ত্রণকারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানীয়দের পতন ঘটে। এরপর যে পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে আজকের লেবানন গঠিত তা ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯২০-৪১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের রক্ষণাধীন ছিল লেবানন। পরবর্তীতে দেশটি ১৯৪৩ সালের ২২ নভেম্বর স্বাধীনতা ঘোষণা করে।১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর লেবানন জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালে খ্রিস্টান ও আরব মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ লেবাননকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।
আরবি ভাষা লেবাননের সরকারি ভাষা।দেশটির ৯০% এরও বেশি লোক আরবি ভাষাতে কথা বলে। এছাড়াও লেবাননে আর্মেনীয় ভাষা, কুর্দি ভাষা ও আরামীয় ভাষা প্রচলিত। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার(৪০০৩৪ বর্গ মাইল) আয়তনের এই দেশটি আয়তনে বিশ্বের ১৬১ তম দেশ। ২০০৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লেবাননের মোট জনসংখ্যা ৪০১৭০৯৫ জন। স্থায়ী নাগরিক ছাড়াও ৪ লাখের মতো উদ্বাস্তু রয়েছে। ফিলিস্তিন থেকে আসা উদ্বাস্তুর সংখ্যা সর্বাধিক ২,৭০,০০০ জন।লেবাননে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী।সুন্নি মুসলমান ২৮ শতাংশ, শিয়া মুসলমানও প্রায় ২৮ শতাংশ। ম্যারোনেইট খ্রিস্টান ২২ শতাংশ। গ্রিক অর্থোডক্স ৮ শতাংশ। দ্রুজ ৫ শতাংশ ও গ্রিক ক্যাথলিক রয়েছে ৪ শতাংশ। খ্রিস্টানদের সংখ্যা মুসলমানদের চেয়েও বেশি ছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ায় মুসলমানদের চেয়ে তাদের সংখ্যা কমে এসেছে।লেবাননে বসবাসরত খ্রিস্টানের সংখ্যা মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বসবাসরত মোট খ্রিস্টানদের সংখ্যার চাইতেও বেশি।
আরব দেশ হলেও অন্যান্য আরব দেশের মতো দেশটিতে রাজতন্ত্র কিংবা পরিবারতন্ত্র নেই।এক বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ ন্যাশনাল এসেম্বলি নামে পরিচিত। লেবানন সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ। যেখানে সরকারের সর্বোচ্চ পদগুলি আনুপাতিক হারে কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকদের প্রতিনিধির জন্য নির্ধারিত। সংবিধান অনুসারে প্রতি ৪ বছর পর সংসদীয় নির্বাচন হয়। আইনসভা আবার ৬ বছর মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি ও আইনসভা একত্রে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। ১৮টি ধর্মীয় গোষ্ঠী লেবাননে বিরাজমান। প্রত্যেকে স্বকীয়তার সঙ্গে নিজ ধর্মের রীতিনীতি ও উৎসব পালন করে। এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায় না। সবার মধ্যে রয়েছে অবিশ্বাস্য ধর্মীয় সমঝোতা।লেবানন ধর্ম ও গোষ্ঠীগতভাবে বিভক্ত একটি রাষ্ট্র হলেও সেখানে পারস্পরিক সম্প্রীতি বেশ জোরদার। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন নজির নেই।এখানে খ্রিস্টান, সুন্নী মুসলমান ও শিয়া মুসলমানেরা একত্রে বাস করেন। গোষ্ঠীগুলি লেবাননের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যাপারে চুক্তি করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী লেবাননের রাষ্ট্রপতি হবেন একজন ম্যারোনাইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হবেন সুন্নি মুসলমান এবং স্পিকার হবেন শিয়া মুসলমান। সেহিসেবে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট মাইকেল আউন, প্রধানমন্ত্রী হাসসান দিয়াব এবং স্পিকার হলেন নাবিহ বেররি। সংসদের আসনসমূহের অর্ধেক খ্রিস্টান ও অর্ধেক মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত।
লেবাননের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল গোষ্ঠী বা গোত্রভিত্তিক। এখানে প্রতিটি গোষ্ঠী বা দল তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ও অধিকার সমানভাবে পেয়ে থাকে। লেবাননে উৎসব হিসেবে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের উৎসবে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছুটির দিনগুলোও নির্ধারিত হয় সেই অনুসারে।লেবাননের বিচার ব্যবস্থা বৈচিত্র্যময়। নেপোলিয়ান কোড,ওসমানি আইন,গির্জার আইন ও বেসামরিক আইনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সে দেশের বিচার ব্যবস্থা। এছাড়া সেখানে ধর্মীয় আদালতও রয়েছে। সব ধর্মের নিজস্ব আইন অনুযায়ী বিয়ে,তালাক উত্তরাধিকার ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া যায়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক