পুলিশে বিশ্বাস! এর মধ্যে লুকিয়ে আছে...
- মো. নূর এ আলম নুহাশ
- প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২০, ১২:৩২ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৪৬ PM
পুলিশে বিশ্বাস! এই বিস্ময়সূচক বাক্যটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আশা, ভরসা, নিরাপত্তা, সম্পর্ক, ভয়, হয়রানি কিংবা আতঙ্ক। আমাদের দেশের পুলিশ আসলে কতটুকু মানুষের কাছে আস্তে পেরেছে? আদৌ মানুষ পুলিশকে বন্ধু মনে করে কিনা? কিংবা বিপদে পড়লে মানুষ তা থেকে পরিত্রানের জন্য পুলিশকেই মহা বিপদ হিসেবে দেখে কিনা? এসব প্রশ্নই পুলিশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে।
‘পুলিশ’ শব্দটি দ্বারা আমরা বুঝি এটি এমন একটি সংঘবদ্ধ সংগঠন যা মানুষের সেবা, নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করবে। বড় করে বলতে গেলে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এবং অপরাধীদের ধরে আইনের আওতায় এনে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করার কঠিন কাজটি যাদের হাতে অর্পিত তারা হচ্ছেন পুলিশ।
পুলিশ (POLICE) শব্দটি ভাঙ্গলে দেখা যায়- P= Polite (বিনয়ী); O= Obedient (অনুগত্য); L= Loyal (বিশ্বস্ত); I= Intelligent (বুদ্ধিমান); C= Courageous (সাহসী); E= Efficient (দক্ষ); এই সকল শব্দগুলো একমাত্র খুঁজে পাবার কথা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। কিন্তু দুঃখের বিষয় পুলিশ বাহিনী নানাভাবে সমালোচিত তাদের কাজ কর্মের জন্য। পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস আসলেই কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা অনুমান করা যাবে কিছু বিষয়কে পর্যালোচনার মাধ্যমে।
পুলিশ ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে অত্যাচারের এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। রোমের সম্রাট অগস্টাসের সময় তার উত্তরাধিকারীরা শাসনের নামে জুলুম করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করতো। এছাড়াও আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রন ও মানব সেবার জন্য পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হলেও শুরু থেকেই তারা ছিন্তাই, হয়রানি সহ বিভিন্ন অপরাধ্মুলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে প্রথম থেকেই পুলিশের প্রতি মানুষের ভয় ও নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে থাকে।
পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য যে দুটি বিষয় সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তার করে তা হলো পুলিশে রাজনীতি এবং দুর্নীতি।
নিজ সুবিধা, স্বজনপ্রীতি মনোভাব ও সরকার দলের চাপে পুলিশও রাজনীতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় পুলিশ বড় ধরনের অপরাধ দমন এর ক্ষেত্রে সরকার দলের কথা অনুযায়ী কাজ করে এবং বাধ্যও থাকে। অনেক সময় পুলিশের সুযোগ সুবিধা ও পদোন্নতি নির্ভর করে তার সরকারি দলের প্রতি ইতিবাচক কর্মকান্ডের উপর। এছাড়াও রাজনীতিবিদরা জনগণকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রন করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে। ফলে পুলিশে রাজনীতির প্রভাব এবং রাজনীতিতে পুলিশের প্রভাব তৈরি হতে থাকে।
উন্নত বিশ্বে পুলিশে রাজনীতির প্রভাব এবং রাজনীতিতে পুলিশের প্রভাব কমিয়ে আনলেও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে পুলিশ প্রশাসন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে এর বিস্তর ব্যাপক। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে পুলিশকে তারা নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে নষ্ট রাজনীতির মধ্যে পড়ে পুরো বাহিনীটির সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
মানুষের সাথে পুলিশের সুদৃঢ় সম্পর্ক না হওয়ার অন্যতম কারণ গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। যেখানে অন্যান্য দেশের তুলনায় বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম সারির দিকে অবস্থান করছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালে দেশে ৪৩৭টি বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার ঘটনা রেকর্ড করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ২০১৯ সালেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩৬১ জন ৷ তারা আরও জানায় যে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৩০০ এরও বেশি ঘটনার অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পায়নি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৫৬ জন ব্যক্তি এরকম বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলো, তার আগের বছর ২০১৫ সালে এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলো ১৭৮ জন ব্যক্তি। ২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এ হত্যাকান্ডকে বর্তমান সরকার ও তার পূর্ববর্তী সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড হিসেবে স্বীকার করা তো দূরের কথা এর দায়িত্বও কখনও নেয়নি।
মাদকবিরোধী অভিযান, বন্দুকযুদ্ধ, গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামীদের ক্রসফায়ার কিংবা বিরোধীদলের উপর চালানো গুম, খুনের ঘটনা পেছন থেকে নিয়ন্ত্রন করে সরকারিদলের রাজনীতিকরা। অনেক সময় সরকারদলীয় কর্মীরা বিভিন্ন অপরাধ মূলক কর্মকান্ড ঘটালেও পুলিশের কিছুই করারা থাকে না বরং পুলিশও সেখানে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় এবং নিজ সুবিধা ভোগের চেষ্টা করে।
সরকার দলীয় রাজনীতিকদের আদলে থাকায় পুলিশ নিজকে জনগণের প্রভুর মতো মনে করে। যার ফলে মানুষ এবং পুলিশের সমন্বয় সাধনে দূরত্ব তৈরি হয়। তবে পুলিশের সম্মানকে সব থেকে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে পুলিশে দুর্নীতি।
টিআইবির গবেষণা মতে, পুলিশ বলপূর্বক অর্থ আদায় বা ঘুষের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত। তাদের গবেষণায় ৭০ শতাংশ মানুষই বলেছেন ঘুষ না দিলে কোন সেবাই পাওয়া যাবে না। অনেক সময় মামলা নিতে, মামলা পরিচালনা করতে কিংবা অবৈধ কাজ করার অনুমুতি দিতে পুলিশ ঘুষ নিয়ে থাকে। ঘুষ নেয়ার জন্য নিরাপরাধ ব্যক্তিকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মামলা দেয়া হয় আবার ঘুষ পেয়ে সুনির্দিষ্ট আসামীদের গ্রেফতার করা হয় না।
এছাড়া স্বজনপ্রীতি, প্রিয়তোষণ ও আত্মসাৎ এর মতো নেতিবাচক আচরণে পুলিশ জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ হাজারো প্রতিকুলতার মাঝে অনেক দায়িত্বপূর্ণ ও প্রশংসার কাজ করলেও অনেকসময় ছোট খাটো দুর্নীতি, ঘুষ ও খারাপ আচরণের কারণেও তাদের দায়িত্বশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তবে পুলিশের এই নেতিবাচক দিক কাটিয়ে না ওঠার কারণ হলো পুলিশ ব্যবস্থাপনা ও সংঘবদ্ধকরণে ত্রুটি এবং পুলিশ একটি রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে সরকারিদলের অধীনে হয়ে কাজ করে। বাংলাদেশ পুলিশ বা অন্যান্য অনুন্নত ও মধ্যম আয়ের জনবহুল দেশের পুলিশ ব্যবস্থাপনা ও সংঘবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে অন্যতম ত্রুটি জনগণের তুলনায় পুলিশ বাহিনী পর্যাপ্ত কিনা এবং পুলিশ বাহিনী সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে কিনা?
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৮৮ জন পুলিশ রয়েছে। জাতিসংঘের মানদন্ড অনুযায়ী প্রতি ১ লাখের জন্য কমপক্ষে ২৩০ জন পুলিশ থাকা প্রয়োজন। ছোট শহর বা গ্রামের তুলনায় বড় শহরে বেশি পুলিশ সদস্য কাজ করে। ফলে গ্রামে বা ছোট শহরে এ ঘাটতি অনেক বেশি। আবার কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমাণ পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে অপরাধ দমন, তা চিহ্নিতকরণ ও সামগ্রিকভাবে আইন শৃংখলা রক্ষায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ পাওয়া যায় না।
একজন মানুষ পুলিশের চাকরি করার আগে সেবা গ্রহণকারী হিসেবে এবং পুলিশে চাকরি পাবার পর সেবা সরবরাহকারী হিসেবে উপযুক্ত কিনা সেক্ষেত্রে একটি দেশের ও জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি কতটুকু ইতিবাচক তার উপর নির্ভর করে। সুতরাং জাতির শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা পুলিশের ইতিবাচক আচরণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশের পুলিশ ব্যবস্থাপনা আগের থেকে আধুনিক করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এখনও গতানুগতিক ধারা অবলম্বন করা হয়। যেমনঃ গুরুতর বা আলোচিত ঘটনা ছাড়া সব ধরনের অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা অবলম্বন করা হয় যার ফলে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট এবং মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়।
এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ ১৮৬১ সালে তৈরিকৃত আইন দ্বারা পরিচালত হয় যেখানে সময় এর সাথে অনেক বিষয় পরিবর্তন করা বা পরিমার্জন করার দরকার ছিল যা এখনো করা হয়নি। যার ফলে বর্তমানের অনেক বিষয় এর সাথে এই আইন সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না। যেমন, পুলিশ কোন অপরাধ করলে তার যে জরিমানা এবং শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা বর্তমানের তুলনায় অতি নগন্য। যার ফলে পুলিশ নিজ অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকেও সহজে বের হতে পারছে না।
এর বাইরেও জিজ্ঞাসাবাদ, জবানবন্দি, রিমান্ড এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী না করার কারণে পুলিশের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে।
পুলিশের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে যায় কিছু বলা যাক না কেন, দিনশেষে মানুষ বিপদে পড়লে ভয় পেয়ে বা অন্য কোন কারণ থাকলেও পুলিশকেই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য উপযুক্ত সাহায্যকারী ভাবার চেষ্টা করে। তাই সরকার এবং পুলিশ বাহিনীর উচিত মানুষের দুর্বলতা এবং বিপদ কে সম্মান করে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে মানুষ নির্দ্বিধায় পুলিশকে বিশ্বাস করে এবং সর্বোচ্চ বন্ধু ভাবে।
লেখক: ৩য় বর্ষ, অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগ , মাভাবিপ্রবি