২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:০৭

পূর্ব বাংলার জনগণের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ভাষা আন্দোলন

জান্নাতুল মাওয়া ও ভাষা আন্দোলন  © সংগৃহীত

পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের জনগণের গণচেতনার প্রথম প্রকাশ ১৯৫২ সালে সংঘটিত হওয়া ভাষা আন্দোলন। ভাষার দাবী আদায়ের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানান দেয় বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টায় বাঙ্গালিরা পাক-শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে।

“দ্বি-জাতিতত্ত্ব”র ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ব-পাকিস্তান অংশের জনগণের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সহ নানা চক্রান্ত শুরু হয় বাঙালীর বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেসব চক্রান্তের চরম জবাব দেয় বাঙালীরা। ১৯৫২ সালে যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে।

সেসময় বাংলা ভাষা পাকিস্তানী জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল। এরপরও তখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলাকে উপেক্ষা করতে থাকে। এছাড়া তখন পাকিস্তানের অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ ভাষাও উপেক্ষিত হতে থাকে। এই শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার হয় এদেশের জনগণ।

শুরুতে তমুদ্দুন মজলিস কর্তৃক ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম পত্রিকা “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, বাংলা না উর্দু”। এ পুস্তিকায় অধ্যাপক আবুল কাশেম, কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ বাংলা ভাষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। তারা এতে উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান।

স্ট্যাম্পবিরোধী আন্দোলন ছিল পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ আন্দোলন। এটি ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে সংঘটিত হয়। ক্রমাগতভাবে এ প্রতিবাদ আন্দোলন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। এদিকে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারির দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নতুন করে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়।

প্রথমত বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) অফিস আদালতের ভাষা ও শিক্ষার বাহন। দ্বিতীয়ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি- বাংলা ও উর্দু। ভাষার প্রশ্নে এ দুটি দাবী উপস্থাপন করে সংগ্রাম পরিষদ।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু ভাষায় অধিবেশনের কার্যক্রম রেকর্ড শুরু হয়। উপস্থিত সদস্যদের সম্মুখে তখন প্রতিবাদ করেন পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেসময় তিনি বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবী জানান। গণপরিষদ এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।

ভাষার আন্দোলনের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন সংগঠনের মিলে এক সভার আয়োজন করে। উক্ত সভা ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে কামরুদ্দীন আহমেদকে সভাপতি করে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়।

১১ মার্চ থেকে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় সংগ্রাম পরিষদ। প্রথম দিনেই ঢাকায় বহু ছাত্র আহত হয়। এবং শেখ মুজিবুর রহমান,শামছুল হক ও অলি আহাদসহ অনেকে গ্রেফতার হন।

উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৩ মার্চ পুনরায় ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকলে এতে অংশ নেয়। এবং ১৫ মার্চ পর্যন্ত এই ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৫ মার্চ এ অবস্থায় সংগ্রাম পরিষদের সাথে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন আলোচনায় বসেন এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আটক ছাত্রদের মুক্তি,পুলিশী অত্যাচারের তদন্ত, আইন পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন এবং ১৪৪ ধারাসহ সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তিতে উল্লেখ ছিল।

এদিকে ১৯৪৮ সালের ২১মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণ দেন। ভাষণে উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে তিনি ঘোষণা করেন। এছাড়া ২৪মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা “না”,“না” বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে ইসলামি আদর্শের ধুয়ো তুলে বাংলা ভাষার জন্য “আরবি হরফ” প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। আরবি হরফ প্রচলনের জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়োগের প্রস্তাব উঠলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের শেষদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের পক্ষে তাকে দেওয়া মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। কিন্ত বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

ফিরে গিয়ে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে ঘোষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলার জনগণ এ ঘোষণার প্রতিবাদ জানালে গণপরিষদে ভাষার প্রশ্নে আলোচনা স্থগিত হয়ে যায়।

১৯৫১ সালে আততায়ীর হাতে লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন,“উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। এ ঘোষণার প্রতিবাদে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও হরতাল কর্মসূচী ডাকা হয়। সেদিনই কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব ও ছাত্রনেতা মহিউদ্দীন আহমেদ রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করে। নুরুল আমিন সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়।

কিন্ত ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করে। এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান দিতে দিতে প্রাদেশিক পরিষদ মুখে অগ্রসর হয়। পুলিশ উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করলে সংঘর্ষ বাধে। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন জব্বার, রফিক, বরকত, সালামসহ বহু ছাত্র জনতা।

এর প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। এ শোভাযাত্রার ওপরেও পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন শফিউর রহমান। এদিনই মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে ছাত্রদের আলোচনায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউর রহমানের পিতা আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ শহীদ মিনারটি গুড়িয়ে দেয়।

এ পরিস্থিতিতে নুরুল আমিন সরকার প্রাদেশিক পরিষদে সিদ্ধান্ত নেয় যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করার জন্য গণপরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। অবিরাম ছাত্র ও গণ আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এবং ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়।

ভাষা আন্দোলনের চেতনাই পরবর্তী সময়ে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলনের প্রেরণা জোগায় এবং জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রাখে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ এন্ড লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়