পাবলিক-প্রাইভেটের শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছাত্র মনে করে না
- আমিনুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৪:০৬ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:৪৮ PM
এক মা হার্ট-এ্যাটাকে মারা গিয়েছে। এই মা হার্ট-এ্যাটাক করেছে একটা গুজব শুনে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে এই মায়ের ছেলে গিয়েছিলে ভারতে। ভারত থেকে ফেরার পথে ইমিগ্রেশন কর্মীরা তার গায়ে জ্বর থাকায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এদিকে পুরো এলাকায় গুজব রটিয়ে দেয়া হয়- তার করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। পুলিশ তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।
ছেলের এই সংবাদ শুনে মা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গিয়েছে। এরপর জানা গেল ওই ছেলের কিছু'ই হয়নি। গায়ে জ্বর ছিল। যেহেতু ভারতে গিয়েছিল, তাই সতর্কতার জন্য তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিলো চেকআপ করার জন্য।
এই সংবাদটি আমি যেই দিন পত্রিকায় পড়েছি, সেই একই দিন ওই একই এলাকায়, মানে সাতক্ষিরার শ্যামনগরের অনেকে অবশ্য ভ্যালেন্টাইন ডে; মানে ভালোবাসা দিবসও পালন করেছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশ আর সমাজ!
এরা আধুনিক হতে হতে ভালোবাসা দিবস, প্রপোজ ডে, কিসিং ডে, প্রমিজ ডে সব কিছুই পালন করে বেড়ায়! আবার মহা আনন্দে চাঁদে মানুষ দেখা গিয়েছে কিংবা পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে; এই জন্য ছেলে ধরা সন্দেহে দিনে দুপুরে পিটিয়ে স্কুল ছাত্রীর মাকে হত্যা করে! এইসব গুজব ছড়ানোর সাথে লেখাপড়া কিংবা উচ্চ শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই।
দেশে এবং বিদেশে আমি এমন অনেক বাংলাদেশিকে চিনি এবং জানি; যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে মহা আনন্দে এমন গুজব বিশ্বাস করে এবং মহা আনন্দে সেটা রটিয়ে এবং ছড়িয়ে বেড়ায়। তো, এরা কেন এমন করে?
এটিএন নিউজের এক টকশোতে অবশ্য এই নিয়ে একবার বলেছিলাম। কারণ গুজব ছড়িয়ে আমরা আনন্দ পাই। মজা পাই। আমরা ভাবি- এতে আমার তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। যা হবার অন্যদের হচ্ছে। আর এই ‘অন্যদের’ মানে নিজে ছাড়া অন্য যে কাউকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে, তাদের ছোট করে বেড়াতে আমরা মহা আনন্দ পাই।
আমি অনেক দিন ধরে একটা বিষয় লিখে আসছি। আমার ধারণা আমরা বাংলাদেশিরা অন্যকে ছোট করার মাধ্যমে জগতে সকল সুখ খুঁজে ফিরি। এ এক অদ্ভুত সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি। আজ দেখতে পাচ্ছি ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিনেতা এবং লেখক মারজুক রাসেলের ছবি। মারজুক রাসেল বইয়ের উপর বসে আছে। এই নিয়ে এখন আমাদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সবাই ছবিটা শেয়ার দিয়ে বলছে- বইয়ের প্রতি এতটুকু সম্মান থাকলে এই লোক কি করে এভাবে বইয়ের উপর বসতে পারে!
মানেটা কি? বইয়ের উপর বসলে সমস্যা কোথায়? আপনারা যখন বইয়ের পাতায় তৈরি ঝালমুড়ির প্যাকেট খেয়ে রাস্তায় ফেলে দেন, তখন কোন সমস্যা হয় না? দেখুন, শ্রদ্ধা- সম্মানবোধ হচ্ছে আপনার মনে। সেটা তো দেখিয়ে বেড়াবার বিষয় না।
যেই দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে প্রাইভেটের ছাত্রদের মানুষই মনে করে না; যেই দেশে পাবলিক আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ছাত্রই মনে করে না! যেই দেশে ফার্মেসী সাবজেক্টে পড়লে, ফিজিক্সের ছাত্রদের পাত্তাই কেউ দিতে চায় না!
যেই দেশে বিসিএস ক্যাডাররা অন্য পেশার লোকজনদের মানুষই মনে করতে চায় না! যেই দেশে পুলিশে চাকরি করলে এমনকি সেলুনে লাইনে না থেকে আগে চুল কাটার জায়গা পাওয়া যায়; বাজারে সবার বড় মাছটা প্রায় বিনা মূল্যে কিনে ফেলা যায়! আর অন্যরা দামা-দামি করতে করতে গলা ফাটিয়ে ফেলে!
যেই দেশে কেউ কাউকে এতটুকু শ্রদ্ধা কিংবা সম্মান দেখাতে চায় না! যে যেভাবে পারছে অন্যকে ছোট করে নিজে বড় হতে চাইছে! পারলে গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে- সেই দেশে এখন লোকজন কথা বলছে মারজুক রাসেল কেন বইয়ের উপর বসে আছে!
এই জনপদে সব কিছু'ই হচ্ছে লোক দেখানো! বই গুলো'কে ধরে দুটো চুমু খেলে মনে হয় এরা শান্ত হতো! এখানেও আবার সমস্যা! ভালোবেসে আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষ'কে চুমু খাবেন! হয়েছে কাজ! এই নিয়ে শুরু হবে আরেক গুজব!
আজকাল তো আবার ভালোবেসে পার্কে প্রেমও করা যায় না! এলাকার সাংসদ কিংবা পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়!
কেন, সমস্যা কিসের এতো আপনাদের? হোক না সে ছেলে-মেয়ে; মেয়ে- মেয়ে; ছেলে- ছেলে; শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! আপনাদের সমস্যা কোথায়? তারা কি অন্যায় কিছু করছে? পার্কে বসে একসাথে গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে; প্রেম করছে। এতেও আপনাদের সমস্যা!
তারা কি ধর্ষণ করছে? তারা কি ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পাচার করছে? তারা কি ডাকাতি করছে? তারা কি হাজার হাজার কোটি টাকার শেয়ার বাজারের টাকা মেরে দিচ্ছে? এইসব করলে অবশ্য কোন সমস্যা নেই! এই দেশে এদের সবাই সালাম দেয়, সম্মান করে!
আপনি পর্দা'র আড়ালে ধর্ষণ করুন; রাতের অন্ধকারে পতিতালয়ে যান কোন সমস্যা নেই! এইসবে এই দেশে মানুষের কোন সমস্যা নেই! আর একজন লেখক কেন বইয়ের উপর বসে আছে- এই নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়!
দুই দিন পর হয়ত বাংলাদেশি ফেসবুকার আর অন লাইন পত্রিকা গুলো শিরোনাম করবে- জেনে নিন শিক্ষক এবং লেখক আমিনুল ইসলাম কেন বিয়ে করছে না এর ১০টি কারন (ভিডিও সহ!)
পৃথিবী এগুচ্ছে; আর আমরা পেছাতে পেছাতে মধ্য যুগে ফেরত যাচ্ছি! (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)