প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন সময়সূচি ইতিবাচক, তবে সমস্যাও আছে
নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচিতে আনা হয়েছে ব্যপক পরিবর্তন, যা খুবই ইতিবাচক। তবে পরিবর্তিত সময়সূচি অনুযায়ী বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ব্যাপকভাবে। মূলত সেজন্যই আজকের এই লেখা।
নতুন সময়সূচি অনুসারে এক শিফট এবং দুই শিফটের উভয় ধরনের বিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হবে সকাল ৯টায়। যদিও উভয় ধরণের বিদ্যালয় শেষ হওয়ার সময় এক নয়। এক্ষেত্রে এক শিফটের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে শেষ হবে কিন্তু দুই শিফটের বিদ্যালয় শেষ হবে বিকেল ৪টায়।
প্রথমত বিদ্যালয় শুরুর সময় সকাল ৯টা হওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে। এক শিফট কিংবা দুই শিফট, উভয় ধরণের বিদ্যালয়ে প্রথম পিরিয়ডে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। বিষয়টির কারণ ব্যাখ্যা করতে হলে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বাস্তবতা একটু অনুধাবন করা দরকার।
বাংলাদেশের প্রায় ৯০% মানুষ মুসলিম, যাদের অধিকাংশই ধর্মপ্রাণ মুসলমান। একসময় গ্রামে গ্রামে মক্তব ছিলো ধর্মীয় শিক্ষার জন্য, এখন যে স্থানটি দখল করেছে নুরানী মাদ্রাসা। ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কারণেই হোক অথবা মাদ্রাসার শিক্ষিত আলেমদের কারণেই হোক, বাস্তবতা হলো প্রতিটি গ্রামেই এখন একাধিক, ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও ৫/৭ টি নুরানী মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে এমন কোন বিদ্যালয় নেই যে বিদ্যালয়ের ক্যাচম্যান্ট এরিয়াতে কমপক্ষে ১/২টি নুরানী মাদ্রাসা নেই।
সকাল বেলা অধিকাংশ শিশু মক্তবে কিংবা নুরানী মাদ্রাসায় যায় আরবী পড়তে, কুরআন শিখতে। তারাই আবার আরবী পড়া শেষে স্কুলে যায় বাংলা মিডিয়ামে পড়তে। আরবী পড়া শেষ করে বাড়িতে ফিরে গোসল, খাওয়া দাওয়া সেরে শিশুটি যখন একটু দূরে অবস্থিত বিদ্যালয়ে পৌঁছায় ততক্ষণে এক দুইটি পিরিয়ড শেষ হয়ে যায়।
সাধারণত দিনের প্রথম ক্লাশ গুলোতে অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রুটিনে অন্তর্ভূক্ত থাকে। সেক্ষেত্রে যে শিশু প্রথম দিকের ক্লাশগুলো করতে পারলোনা সে লেখাপড়ায় পিছিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। যার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিশুর শিক্ষা জীবনে। অপরদিকে সকাল ৯টার স্কুল টাইমের প্রভাব পড়েছে শিক্ষকদের জীবনের রুটিনেও।
শিক্ষকদের সময়মতো বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন সর্বশেষ সংযোজন। নিঃসন্দেহে এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ঠিক ৯টায় হাজিরা দিতে হলে শিক্ষককে অবশ্যই ৯টার পূর্বে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে হবে। সেক্ষেত্রে বাড়ি যদি একটু দূরে হয় তাহলে কমপক্ষে এক ঘন্টা বা ক্ষেত্র বিশেষে দেড় ঘন্টা আগেও রওয়ানা হতে হচ্ছে।
কারণ গ্রামাঞ্চলে যানবাহন সংকট এখনো ব্যাপক, বর্ষায় তো আরো খারাপ অবস্থা। আবার নিজে তৈরি হতেও অন্তত ৩০ মিনিট সময় দরকার। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে গড়ে দুই ঘন্টা আগে কর্মস্থলের জন্য তৈরি হতে হচ্ছে। যদি তিনি নারী হন তাহলে তার ভোগান্তি আরো বেশি। কারণ পরিবারের সবার দিনের খাবারের জোগাড় করে তাকে বের হতে হয়, তাই তার কর্মযজ্ঞ শুরু হয় মূলত ফজরের পর পর। এতোটা দৌড়ঝাঁপ করে বিদ্যালয়ে হয়তো তিনি ঠিকই পৌঁছান কিন্তু শিক্ষার্থীদেরকে কতোটুকু দিতে পারেন সেটা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।
অন্যদিকে নিজের এবং পারিবারিক জীবনেই তিনি শান্তিতে আছেন তা আশা করা যায়না। তাই সবদিক বিবেচনায় বিদ্যালয় শুরুর সময় কমপক্ষে এক ঘন্টা পিছিয়ে নিলে সবাই উপকৃত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের জন্যই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার সকল আয়োজন যার রূপকার হচ্ছেন শিক্ষকরা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকগণ জন্য কতোটা উপকৃত হচ্ছে কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বর্তমান সময়-সূচী কতোটা ইতিবাচক প্রভাব রাখছে তা বিবেচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
উন্নত বিশ্বের ন্যয় এগিয়ে যেতে চাইলে শিক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্যই উন্নত দেশের মডেল অনুসরণ করতে হবে তবে নিজেদের বাস্তবতাকে অস্বীকার করারও কোন উপায় নেই। তাই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার বিজ্ঞ কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে সুনজর দিবেন বলে আশা করা যায়। তবে এক্ষেত্রে যতো দ্রুত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হবে ততো দ্রুত আমরা ইতিবাচক ফল পাবো বলে আশা করা যায়। এগিয়ে যাক আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা, এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। সবার জন্য শুভকামনা।
লেখক: সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সুবর্ণচর, নোয়াখালী