ইভিএমে ভোট দেবেন যেভাবে

ইভিএম মেশিন
ইভিএম মেশিন  © টিডিসি ফটো

আগামি ১ ফেব্রয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তাপ ও উত্তেজনা তো রয়েছেই। আবার এর সঙ্গে বাড়তি যুক্ত হয়েছে নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া না নেওয়ার বিতর্ক। ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন হচ্ছে আধুনিক বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট প্রয়োগ বা সংশ্লিষ্ট ভোটারদের স্বীয় মতামত প্রতিফলনের অন্যতম মাধ্যম। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি অনুসৃত হয় বলে সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নামে পরিচিত।ইভিএমের অন্য নাম ই-ভোটিং।

নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়ার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি তুলেছে।যদিও নির্বাচন কমিশন এসব রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি গায়ে মাখছে না। এবারের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ের একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে ইভিএমে ভোট গ্রহণ পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানলাম তা আজ পাঠকদের উদ্দেশ্যে শেয়ার করবো। পরবর্তীতে কোনো একটি লেখায় ইভিএমের সুবিধা ও সীমাবদ্ধতার কথা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষা রইল।

ইভিএমে বিশ্বে ভোট নেওয়ার ইতিহাস বেশ পুরোনো।পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে ভোট প্রদানের রূপরেখা আবিষ্কারের পটভূমিতে ১৯৬০-এর দশকে ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগে নির্বাচন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে আমেরিকার ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি অনুসৃত হবার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহারের চিত্র চোখে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইভিএমের সাহায্যে ইতোমধ্যেই ভোট নেয়া হয়েছে।যেমন অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ইটালী, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, কানাডা, এস্তোনিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভেনেজুয়েলা এবং ফিলিপাইন।

বাংলাদেশের নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের ইতিহাস বেশিদিন আগের নয়। ২০০৭ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের কার্যকরী সংসদ নির্বাচনে পুরনো ব্যালট পেপার পদ্ধতির পরিবর্তে ইভিএম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।পরবর্তীতে আংশিক ও পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।২০১০ সালের জুন মাসে স্বল্প পরিসরে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ইভিএম চালু করা হয়। ২০১২ সালে জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশনে সবগুলো কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়।স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের পর জাতীয় পর্যায়ে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম বারের মতো ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।

একজন ভোটার ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ইভিএমে ভোট দেবেন যেভাবে। প্রথমত ভোটার যে কক্ষে ভোট দেবেন সেই কক্ষের দায়িত্বরত নির্বাচনী কর্মকর্তা তিনটি উপায়ে একজন ভোটারকে সনাক্ত করবেন। তিনি সেই কক্ষের ভোটার কিনা? আগে সেটি তালিকা দেখে নিশ্চিত হবেন। এরপর ফিঙ্গার প্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে,লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা স্মার্ট পরিচয়পত্র দিয়ে ও ভোটার নাম্বার দিয়ে ভোটার তার ভোট প্রক্রিয়ায় শামিল হবেন। নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোটকক্ষে একজন করে ভোটার ভেরিফিকেশন করেন পোলিং অফিসার। ডাটাবেজে ভোটার বৈধ হিসেবে শনাক্ত হলেই মনিটরে দেখা যাবে। মনিটরটি ভোটকক্ষের এমন স্থানে স্থাপন করা হবে, যেখান থেকে ভোটারের পরিচয় সম্পর্কে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার দুই দলের পোলিং এজেন্ট ও ভোটার নিজে দেখতে পারবেন। ভোটার সনাক্ত হওয়ার পর তিনি গোপন কক্ষে প্রবেশ করবেন। সেখানে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের তিনটি পদের জন্য আলাদা তিনটি ব্যালট ইউনিট থাকবে।এখানে বলে রাখা প্রয়োজন ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরেই ব্যালট ইউনিটের মনিটর স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করবে। তখন বিভিন্ন প্রার্থীর নাম এবং প্রতীক দেখা যাবে। অন্য সময় এই যন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে। বোতাম চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারে।

একটি ভোট দিতে আনুমানিক ১৪ সেকেন্ড সময় লাগে।এতে একটি মেশিনে প্রায় চার হাজার পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করা যায়।ব্যালট ইউনিটের প্রত্যেক প্রার্থীর নাম ও প্রতীকের পাশে আলাদা সাদা বোতাম থাকবে। বোতামে চাপ দিলে যন্ত্র থেকে স্বয়ংক্রিয় বার্তায় বলা হবে, ‘আপনার পছন্দের প্রতীক নিশ্চিত হলে সবুজ বোতাম চাপুন’। এরপর নিচে থাকা সবুজ বোতাম চেপে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।কোনো ভোটার যদি ভুলে অন্য প্রতীকের পাশের বোতামে চাপ দিয়ে ফেলেন, তাহলে সবুজ বোতাম না চেপে তৎক্ষণাৎ সঠিক বোতাম চাপতে পারবেন। এভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগে দুবার বদলানোর সুযোগ পাবেন। তবে তৃতীয়বার যে প্রতীকের পাশের বোতাম চাপা হবে, ভোট সেই প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।সবুজ বোতাম চাপ দেওয়ার পর আপনার ভোট দেওয়া প্রতীক ছাড়া বাকি সকল প্রতীক অদৃশ্য হয়ে যাবে। এতে আপনি নিশ্চিত হবেন যে, ওই প্রতীকে আপনার ভোট প্রদান প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

আপনি ইচ্ছে করলে না ভোটও দিতে পারেন।ব্যালট ইউনিটের লাল বোতাম পরপর দুইবার চাপ দিলে আপনি না ভোট দিয়েছেন বলে গণ্য করা হবে। তবে তিনটি ব্যালট ইউনিটেই তিনজন প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে। একজন বা দুজন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে গোপন কক্ষ ত্যাগ করলে আপনার ভোট কাউন্ট হবে না বরং মনিটরে তা অসম্পূর্ণ দেখাবে। ভোটার যখন ভোট দিতে কক্ষে ভেতরে থাকবেন, তখন বাইরের মনিটরে লেখা থাকবে, ‘ভোট গ্রহণ চলছে।ভোট দেওয়া সম্পন্ন হলে বাইরের মনিটরে, মোট ভোটারের সংখ্যা এবং যতজন ভোট দিয়েছেন, তাদের সংখ্যা দেখা যাবে। একজন ভোটারের কোনোভাবেই একটির বেশি ভোট দেয়ার সুযোগ থাকে না। এক কেন্দ্রের ভোটারের অন্য কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার সুযোগ নেই।সাধারণ ব্যালট ভোটের মতো কেন্দ্রেও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্টরা, নেতাকর্মীরাসহ পর্যবেক্ষকরা তো থাকবেই। ইভিএমে একটি পূর্ব-প্রোগ্রামিং করা মাইক্রোচিপ থাকে যা প্রতিটি ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে হিসাব করে প্রদর্শন করে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ