পিতাকে হটিয়ে ৫০ বছরের সুলতান কাবুস
সদ্য প্রয়াত হলেন উপসাগরীয় দেশ ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ। তিনি প্রায় ৫০ বছর ওমানের সুলতান হিসাবে দেশটি শাসন করেন।সুলতান কাবুস ১০ জানুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। গত মাসে বেলজিয়ামে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সুলতান কাবুস অবিবাহিত ছিলেন এবং তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না।
উপসাগরীয় দেশ ওমানের আয়তন ২ লক্ষ ৭২ হাজার বর্গকিমি।ওমান আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণাতে অবস্থিত।ওমানের পশ্চিমে ইয়েমেন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, পূর্বে আরব সাগর, উত্তরে ওমান উপসাগর।ওমানের জনসংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ, যার মধ্যে ৪৩ শতাংশ বিদেশী নাগরিক।মূলত ভারত,বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইরান থেকে আগত বিদেশী কর্মী।জনসংখ্যার ইবাদি মুসলিম ৭৫%, বাকিরা সুন্নি ও শিয়া মুসলিম।
ওমান ১৯৫১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সদস্য হয়। দেশটিতে কোনো সংবিধান নেই। চরম রাজতন্ত্র বিদ্যমান। সুলতানই দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কোনো রাজনৈতিক দলও নেই ।নেই জনগণের ভোটাধিকার। দেশটির রপ্তানির ৯০% তেল।
১৯৩২ হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ওমানের শাসক ছিলেন সুলতান কাবুসের পিতা সাঈদ বিন তাইমুর। প্রজারা বিদ্রোহ করতে পারে এ ভয়ে সুলতান তাদের শিক্ষা, বিদেশ গমন, ও বিলাসিতার ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং যাবতীয় অর্থ নিজের ভান্ডারে জমা রাখতেন। এমনকি তার আপন পুত্র কাবুসকে তিন বছর বন্দী করে রেখেছিলেন সাঈদ বিন তাইমুর। সুলতান কাবুস ১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রাদেশিক রাজধানী সালালাহে কয়েক বছরের পুরনো আল-সাঈদ রাজপরিবারে তাঁর জন্ম।তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সালালাহ ও ভারতের পুনেতে লাভ করেছেন। পুনেতে তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মার ছাত্র ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে কাবুস ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য যান।স্যান্ডহাস্ট রয়েল সামরিক অ্যাকাডেমি থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন ।পরে ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে জার্মানিতে চলে যান। তিনি জার্মানিতে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন।
সালালাহতে ফিরে আসার পর তিনি ইসলাম এবং দেশের ইতিহাসের উপর পড়াশোনা করেছেন।তাঁর বাবা সুলতান সাঈদ বিন তাইমুরের কড়া নজরদারি থেকে বাঁচতে অনুকূল সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন কাবুস। ১৯৭০ সালে ২৩ জুলাই ২৯ বছর বয়সে কাবুস ব্রিটিশ সৈন্যদের সহায়তায় এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে তাঁর বাবা সাঈদ বিন তাইমুরকে সরিয়ে ওমানের সুলতান হন।
এরপর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা শাসক হন ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ।১৯৭৬ সালে সুলতান কাবুস বিয়ে করেন। কিন্তু সেই বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। তিনি পুনরায় বিয়েও করেননি, যার কারণে তার কোনো সন্তান নেই। এমনকি তিনি পিতার একমাত্র সন্তান হওয়ায় তার কোনো উত্তরসূরিও নেই।
ক্ষমতার লোভ ও মোহে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে ইতিহাসে শুধু ওমানের সুলতান কাবুস'ই পিতাকে বিতাড়িত করেই সিংহাসনে সমাসীন হয়েছিলেন এমনটি নয়। যুগেযুগে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সীমানা ছিল রাজা-বাদশার পরিবারের মধ্যে। তাতে সিংহাসনের মোহে ও লোভে পিতা পুত্রকে এবং পুত্র পিতাকে ক্ষমতাচ্যুতসহ হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। গ্রিক পৌরাণিক কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, জিউস দেবতাদের রাজা হয়েছিল তার পিতা ক্রোনাসকে হত্যা করে। আর ক্রোনাস তার পিতা ইউরেনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেবকুলের রাজা হয়েছিল।
আধুনিক যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার অপর তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাইকে হত্যা, অপর জন সুজাকে বার্মায় বিতাড়ন এবং বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানকে বন্দী করে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন।বাংলার এমন একজন শাসক ছিলেন যার পারস্যের কবি হাফিজের সাথে পত্র বিনিময় হতো।প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা তাঁর সময়ে সম্পন্ন করেন।
তাঁর সময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়।তাঁর রাজত্বকালেই বিখ্যাত সূফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। এতক্ষণ যার শাসনামলের কথা বললাম তিনি হলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ । গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০) ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতান। তিনিও পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ১৩৮৯ সালে বাংলার সিংহাসন অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
ক্ষমতায় আসার পর সুলতান কাবুস একাধারে সুলতান, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিজের হাতে নেন। ১৯৯৬ সাল থেকে মৌলিক আইনসহ সকল আইন ১৯৭০ সালের রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে প্রচলিত হয়ে আসছে। সুলতান বিচারকদের নিয়োগ করেন এবং সাজা রদ বা হ্রাস করতে পারেন।সুলতান কাবুস ক্ষমতা গ্রহণের পর ওমানে মাত্র ১০ কিলোমিটার পাকা সড়ক এবং তিনটি স্কুল ছিল। সুলতান কাবুস তখন ঘোষণা করেন, দেশটির তেল সম্পদ কাজে লাগিয়ে তিনি দেশের আধুনিকায়ন করবেন।তিনি এরপর ওমানকে প্রায় অবকাঠামোহীন দেশ থেকে একটি আধুনিক দেশে রূপান্তর করেছেন।
১৯৮৬ সালে কাবুস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।ওমানের সদ্য প্রয়াত সুলতান কাবুস সাবেক আরব উপদ্বীপটিকে একটি পশ্চাৎপদ অবস্থা থেকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ দিয়েছিলেন। নিজের সালতানাতকে তিনি যেমন আঞ্চলিক উত্তেজনা থেকে দূরে রাখছিলেন, তেমনি মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল।সুলতান কাবুস কূটনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় বিভিন্ন সময় দেখিয়েছেন।২০১৩ সালে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনার সূত্রপাত করাতে ভূমিকা রাখেন সুলতান কাবুস।তাঁর প্রচেষ্টাতেই ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধ করতেও তিনিই আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলেন।হরমুজ প্রণালীর তীরে ও দুই চির বৈরী ইরান-সৌদি আরবের মাঝে কৌশলগত অবস্থান নেয় ওমান। কিন্তু দুই দেশের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল কাবুসের।সুলতানের প্রথম বিদেশ সফর ছিল ইরানে। বিচ্ছিন্ন দোফার অঞ্চলে উত্তরাধিকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে পাওয়া মার্ক্সবাদী বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন তিনি।সুলতান কাবুস ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী, জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন বিন তালাল, ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সেস ও ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর সহায়তা বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন।
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হবার পরেও পূর্বের সম্পর্ক টিকে আছে।এছাড়া সৌদি আরব ছাড়াও আরব উপসাগরীয় বাকি ছয় দেশের সঙ্গে কাবুসের ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না, এই নীতিতে তিনি অটল ছিলেন।২০১১ সালের আরব বসন্তেও তাঁকে খুবই কম বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ মন্ত্রীদের বরখাস্ত করেই সেই বিক্ষোভ প্রশমিত করতে সক্ষম হন তিনি।
২০১৫ সালে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে অংশ নেয়নি ওমান। এতে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ইয়েমেনে যুদ্ধরত বিভিন্ন গোষ্ঠীদের মধ্যে বন্দিবিনিময়ে সহায়তা করতে পেরেছেন কাবুস।ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের কারণে সামরিক প্রধানসহ পশ্চিমা ও আরব কূটনীতিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন কাবুস।ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে দেশটি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন কাবুস। এতে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। আগেই বলেছি ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় ওমানেও কিছু অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেশটিতে বড় ধরণের কোন বিক্ষোভ হয়নি।ওমানের বিভিন্ন জায়গায় হাজার-হাজার মানুষ ভালো মজুরির দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন।নিরাপত্তা বাহিনী প্রথম দিকে সে বিক্ষোভের প্রতি কিছুটা নমনীয় ভাব দেখিয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং তাজা গুলি ছুঁড়েছে। তখন দুজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। বেআইনি সমাবেশ এবং সুলতানকে অপমান' করার অভিযোগে শতশত মানুষকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।তখন থেকে কর্তৃপক্ষ সরকারের সমালোচক হিসেবে পরিচিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেয়। বিরোধীদের জন্য কোন জায়গা রাখেনি তার সরকার। স্বাধীন আজ্জাম পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে তার সম্পাদককে কারাগারে পাঠান।মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, তখন বিভিন্ন বই বাজেয়াপ্ত এবং মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানিও করা হয়।আধুনিক ওমান রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে সুলতান কাবুস তাঁর নেতিবাচক কাজগুলো ছাপিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ওমানের জনগণ ও উপসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি প্রিয় মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক