শিয়া বিতর্ক ও তাদের প্রধান মতাদর্শ
ইরানী জেনারেল সুলেইমানি আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্রে নিহত হবার পর নতুন করে শিয়াদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শিয়ারা মুসলিম! না কাফির! সেই প্রশ্ন অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শিয়াদের আকীদা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেক ওলামায়ে কেরাম তাদের কাফের ফতোয়া দিয়েছেন, আবার অনেক ওলামায়ে কেরাম শিয়া সম্প্রদায়কে সুন্নি মাযহাবের যে চারটি মাযহাব রয়েছে তেমনি শিয়া সম্প্রদায়কে একটি মাযহাব মনে করেন। সেই হিসেবে শিয়া সম্প্রদায়কে পঞ্চম মাযহাব বলে অভিহিত করেন তারা।
তবে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেছেন, যারা মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নির নামে অনৈক্য সৃষ্টি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল।শিয়া ও সুন্নিদের বর্তমান জনসংখ্যার অনুপাত নির্ণয় করা কঠিন। তবে ধারণা করা হয় পৃথিবীর ৮৫℅ মুসলিম সুন্নি এবং ১৫℅ শিয়া। শিয়াদের অধিকাংশ বারো ইমামের অনুসারী, বাকিরা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত।ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজান, লেবানন, ইয়েমেনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া সিরিয়া, কুয়েত, জর্ডান, ফিলিস্তিন, সউদি আরব, পাকিস্তান, ভারতেও প্রচুর শিয়া রয়েছে ।
শিয়া শব্দটি আরবি।শিয়া শব্দটির অর্থ অনুসারী বা দল। শিয়া ইসলাম অনুসরণকারীদের শিইতি বা শিয়া বলা হয়। শিয়া হল ঐতিহাসিক বাক্য শিয়াত-ই-আলী এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যার অর্থ আলীর অনুগামীরা বা আলীর দল।শিয়া মতবাদের মূল ভিত্তি হলো, হযরত আলী (রা.) এবং হযরত ফাতেমা (রা.)'র বংশের মাধ্যমে নবি পরিবারের (আহলে বায়ত) লোকেরাই হলেন ইমামত বা নেতৃত্বের প্রধান দাবিদার। শিয়া মাযহাব প্রথমে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে।মূলত ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে হযরত আবু বকরের (রা.) নির্বাচনের সময় থেকে শিয়া আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)'র ৬৩২ সালে ওফাতের সময় তাঁর জামাতা হযরত আলী (রা.) খলিফা হবেন বলে তাঁর সমর্থকদের ধারণা ছিল। তখনো তারা ইতিহাসে শিয়া নামে অভিহিত পরিচিত ছিলেন না।
শিয়াদের দাবী ছিল যে,আলী (রা.) খলিফা হবেন নবী করিম (সা.) এমন নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।এছাড়া আলী (রা.) বালকদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, রাসুল (সা.)'র চাচাতো ভাই, জামাতা, রাসুলুল্লাহ (সা.)'র দৌহিত্র হাসান ও হোসেনের পিতা। রাসুলের (সা.)'র কোনো পুত্রসন্তান ছিল না এবং দৌহিত্র হাসান ও হোসেন শিশু ছিলেন। এসবদিক বিবেচনায় রাসূলের (সা.) ইন্তেকালের পর আলীই খিলাফতের নেতৃত্বের সর্বাধিক যোগ্য বলে শিয়ারা মনে করেন। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবু বকর (রা.)প্রথম খলীফা হিসাবে নির্বাচিত হলে তাঁদের এ দাবি উপেক্ষিত হয়।
এতে হযরত আলী (রা.) সমর্থকেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। এরপর হযরত ওমর( রা.) ও হযরত ওসমান (রা.) যখন পালাক্রমে খলিফা নির্বাচিত হলেন, তখনো তাঁরা আলীকে (রা.) খলীফা নির্বাচিত করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। দীর্ঘদিন পর ৬৫৬ সালে ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রা.) শাহাদাত বরণ করলে হযরত আলীর (রা.) খলীফা নির্বাচিত হবার পথ সুগম হয়। কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানের (রা.) আত্মীয় মুয়াবিয়ার (রা.) এর তীব্র বিরোধিতা করেন।
শিয়ারা আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধেও আলীকে সমর্থন করেন।উষ্ট্র ও সিফফিনের যুদ্ধে তারা আলীর পক্ষাবলম্বন করেন। হযরত আলী (রা.) ৬৬১ সালে শাহাদত বরণ করলে তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা.) খলিফা হন। কিন্তু তিনি মুয়াবিয়ার (রা.) নিকট খেলাফত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর অল্পকাল পরেই বিষ প্রয়োগে তাঁকে হত্যা করা হয়। মুয়াবিয়ার (রা.) মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.)'র ছোট ছেলে হযরত হোসেন (রা.) কে খলিফা হিসাবে নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু আমীর মুয়াবিয়া তার পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন।
অবশেষে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে হযরত হোসেন (রা.) ইয়াজিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক অসম যুদ্ধে ৬১ হিজরি তথা ৬৮০ সালে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদত বরণ করেন।কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনায় প্রতিশোধের স্পৃহায় মুসলিমদের দুভাগে বিভক্ত করে দেয়। যা শিয়া নামে পরিচিত লাভ করে। কারবালার ঘটনার পর হতে ইসলামের ইতিহাসে শিয়া সুন্নি নামে দুটি বিবদমান দলের উদ্ভব ঘটে। ঐতিহাসিক পিকে হিট্টি বলেন, ‘The blood of all Hussayn, even more than that of his father, proved to be the seed of Shiite 'church'. Shiism was born on the tenth of Muharram.’ অর্থাৎ হোসাইনের রক্তে তার পিতা পিতার রক্ত অপেক্ষাও অধিকতর শিয়া বীজ নিহিত ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
১০ মহররম শিয়া মতবাদের জন্ম লাভ ঘটে। হযরত আলী (রা.) ও তাঁর পুত্রদের করুণ পরিণতি শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থানে অনুপ্রেরণা জোগায়। শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, নবীর (স.) পাশাপাশি হযরত আলীর (রা.) এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল, যা তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের অধিকার দিয়েছিল। সেই কর্মভার হযরত আলী (রা.) তাঁর অনুসারী ইমামদের দিয়ে গেছেন। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, ইমাম হচ্ছেন বারোজন, যাঁদের মধ্যে হযরত আলী (রা.) প্রথম ইমাম, পরে তাঁর পুত্র হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হোসেন (রা.) এবং দ্বাদশ ও শেষ ইমাম এখনও জীবিত। তিনি পৃথিবী ধ্বংসের আগে ফিরে আসবেন। শিয়া মতবাদ প্রথমে ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক আন্দোলন।
পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে একটি ধর্মমতের রূপ পরিগ্রহ করে। ইদ্রিসী ও ফাতিমিয় নামে শিয়ারা আফ্রিকায় দুটি শিয়া রাজবংশেরও সূচনা করেছিলেন। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সার্বজনীনভাবে হোসেনের শাহাদাতবরণ উপলক্ষে শোক প্রকাশ করা হয়। ষোড়শ শতকে যখন সাফাভি বংশ পারস্যের ক্ষমতায় আসে তখন শিয়া মতবাদ প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রচারিত হতে থাকে। সাফাভি শাসকরা শিয়া মতবাদকে পারস্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।
আসলে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে কিছু বিষয়ে মতভেদ থাকলেও অনেক মৌলিক বিষয়েই রয়েছে মিল। যেমন, উভয় সম্প্রদায় এক আল্লাহ, অভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তথা পবিত্র কুরআন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে সর্বশেষ নবি হিসেবে মানেন। সুন্নি ও শিয়ারা পরকালের প্রতি তথা পুনরুত্থান ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ও নারীদের পর্দা করা ফরজ হওয়ার বিষয়সহ আরো অনেক বিষয়েই তারা সহমত পোষণ করেন। এসব বিষয়ে বিষয়ে তাদের কিছু ছোটখাটো মতভেদ রয়েছে যা সুন্নিদের চার মাযহাবের মধ্যেও রয়েছে।
তবে শিয়া ও সুন্নি মাযহাবের মধ্যে অমিল তথা মতবিরোধের অন্যতম দিক হলো- মহানবী (সা.) এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত তথা খলিফা বা প্রতিনিধি নিয়োগ নিয়ে। সুন্নিরা মনে করেন এ বিষয়টি আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল মুসলিমদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন এবং সাহাবাগণ নির্বাচন পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচন করেছেন। অন্যদিকে শিয়া মুসলিমরা মনে করেন, বিশ্বনবী (সা.) এর স্থলাভিষিক্ত তথা খলিফা বা প্রতিনিধি নিয়োগের বিষয়টি মহান আল্লাহই নির্ধারণ করেন ও তা রাসূলকে (সা.) জানিয়ে দেন। আর এরই ভিত্তিতে হযরত আলী (রা.) এবং এরপর তাঁর বংশধরগণ ছিলেন মুসলমানদের প্রকৃত খলিফা।
এজন্য শিয়ারা আলীকে চতুর্থ খলিফা হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং প্রথম ইমাম হিসেবে বিবেচনা করেন।শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, অনেক বর্ণনা রয়েছে যেখানে ইসলামের নবী তার উত্তরাধিকারী হিসাবে আলীকে নির্বাচিত করেছিলেন।শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, শুধুমাত্র আল্লাহই ইসলাম, কুরআন এবং শরিয়াত রক্ষা করার জন্য একজন প্রতিনিধি (নবী এবং ইমাম) নির্বাচন করতে পারেন সাধারণ মুসলমানরা পারে না। যার কারণে শিয়ারা ইসলাম এবং কুরআনের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জনগণ যে আবু বকর, উমর এবং উসমানকে খলীফা হিসাবে নির্বাচিত করেছেন তা অনুসরণ করেন না।
শিয়ারা সিহাহ সিত্তাহ হাদিসের তুলনায় আহলে বাইতের নিকট থেকে প্রাপ্ত হাদিস সমূহকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করে। শিয়া কালিমা মুসলিমদের শাহাদাহ থেকে ভিন্ন। তাদের কালিমা হলো – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি ‘আলিউন ওয়ালিউল্লাহি ওয়াসিয়্যু রাসুলুল্লাহি ওয়া খালিফাতুহু বিলা ফাসলিন।
আযানের সময় শিয়ারা বলে, আলীয়ু ওয়ালিউল্লা অর্থাৎ আলী আল্লাহর বন্ধু। তারা আরও বলে, ‘হাইয়া আলা খায়রিল আমাল অর্থাৎ ভাল কাজে উদ্যোগী হও)। এ কথাটা তারা দুবার বলে।
এভাবে শিয়া ও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে আরো বেশ কিছু আকীদাগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তবে বর্তমানে ইরানের শিয়া সরকারের মুসলিমদের জন্য কিছু প্রশংসনীয় ভূমিকা শিয়া সুন্নি উভয় সম্প্রদায়কে যেমন আকৃষ্ট করেছে তেমনি সিরিয়া ইয়েমেন ও ইরাকে ইরানের ইন্ধনে সুন্নি মুসলিম নির্যাতন সুন্নিদের আতঙ্কিত করে তুলছে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক