রসকথার ইতিকথা
যখন শুনতে পেলাম খেজুরের রস বলে একজন চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে আমাদের বাসার কাছে, তখন আর কিছুই মাথায় নেই। পড়ার টেবিলে বই নিয়ে যা যা করছিলাম সবই বিসর্জন দিলাম। চোখের সামনে একটা প্লাস্টিকের গ্লাস পেলাম।সেটাই নিয়ে নিলাম। দিলাম এক দৌড়। ভোঁ-দৌড়।পেছন থেকে দাদা ভাই আর আব্বা কী যেন বলে ডাকছিলেন। ভাল করে শুনতে পারিনি। তাই মনে নেই।এক টাকা দিয়ে রস বিক্রেতার কাছ থেকে এক গ্লাস রস খেলাম। খাওয়ার সময় গ্লাসের ভেতর চোখে পড়ল একটা মরা তেলাপোকা। দেহটা অর্ধগলিত অবস্থায় ভাসছে রসের উপড়। তার গায়ে কতগুলো জীবন্ত পিঁপড়ার নাড়াচাড়া। রসে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা। তবে শেষ রক্ষা হলোনা।তেলাপোকাসহ পিপীলিকার দল আমার পাকস্থলিতে ঠিকানা খুঁজে পেল। বুঝলাম দাদা ভাই আর আব্বা বুঝি এই জন্যই আমাকে পেছন থেকে ডাকছিলেন।তখন বিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত শুরু মাত্র। প্রথম শ্রেণির আগের ক্লাস শিশুশ্রেণিতে পড়ি।
সে কখনও রসকুমার । আর কখনও রসকুমারী। রসের বদৌলতে তাকে সবাই চিনে। সবাই জানে। রসই যার আসল আকর্ষণ। রাস্তার ধারে বা বাড়ির এক কোণে যখন সে শরীর হেলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,তখন মনে হয় হাজার বছরের পুরনো কোন ইমারত। বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সকল ইতিহাস আর ঐতিহ্য। সে স্বাক্ষী রয় তিন পুরুষের জীবনে ঘটে যাওয়া সব মুহূর্তের। তার পোশাক বড়ই বিচিত্র। কাঁটা কাঁটা আর সূচালো। ডাল পালাগুলো একটি মাত্র শাখা থেকেই বেড়িয়েছে। পাতাগুলো পাখির পালকের মতো করে সাজানো গোছানো। লালচে আর খয়েরি রঙের দেহে উঁকি মারা সবুজ সবুজ পাতা আর হলদে পাকা খেজুর ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চেনা যায় তাকে। যেন কোন এক সন্ন্যাসী মহাকালের অতল গহবর থেকে ওঠে এসেছে লোকালয়ে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় অপরূপ রূপবতী রমণী।শরীরে তার যৌবনের মায়াজাল। মাটির উপর দন্ডায়মান এই বৃক্ষটি ১৫ থেকে ২৫ মিটার বিস্তৃত হয় উপড়ের দিকে। কোন কোন খেজুর গাছ হয়ে যায় বিশেষ কোন স্থান বা চিহ্ন যা বাড়ি চিনিয়ে দেয় পথ হারানো কোন মুসাফিরকে।অথবা কোন আগন্তুককে। খেজুর গাছ ছাড়া আমাদের সুজলা-সুফলা আর শ্যামলীমায় ঘেরা গ্রাম বাংলা পরিপূর্ণতা পায়না।
খেজুরের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ’ফিনিক্স ডেকটেলিফেরা’।‘ডেকথলো’ এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে যার অর্থ হলো ‘আঙুল’। পরবর্তি অংশ ’ফেরা’ এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে যার অর্থ ’আমি বহন করি।’
ফল দেয় সে এক কালীন। শীতের সৌন্দর্যে তারও ভাগ রয়েছে। মাঠ-ঘাট থেকে শুরু করে একেবারে খাবার টেবিল পর্যন্ত বিচরণ করে তার দেয়া রসের স্বাদ। সেই সাথে সুভাসিত মিষ্টি গন্ধ। কখনও এর রেশ লেগে থাকে কলাবাদুড়ের মুখ থেকে মুখে । উড়ে বেড়ায় আকাশে।বাতাসে। কলাবাদুড়ের দল চোখে দেখেনা। শ্রবণোত্তর শব্দ(আল্ট্রাসোনিক সাউন্ড) সৃষ্টি করে প্রতিধ্বনির মাধ্যমে চলা ফেরা করে তারা। শেষ রাতে একবার।সন্ধ্যায় আরেকবার। হানা দেয় তারা রাসধারীর যৌবনের উপর। ঝুলে ঝুলে খেজুরে রস পানে মিটায় তাদের জ্বালা। শীতকালে ঘন কুয়াশা হলেও বাদুড়ের কোন সমস্যা হয়না। এই রসের যে ঝাঁজ!তাতে পথ চলতে বাদুরের দল আরও প্রাণশক্তি পায়। তবে সব পাখিই কম বেশি খেজুরের রসে মুখ দেয়,দোষ হয় শুধু বাদুড়ের। রসের মিষ্টি গন্ধে আত্মভোলা হয়ে যায় খেজুর গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিক।রাতের বেলায় এর আশপাশে ভিড়তে থাকে অন্ধকারে গ্রামীন জনপদে পায়চারী করা জোনাকীর ঝাঁক ।
খেজুরের রস সংরক্ষণ পদ্ধতিও আরেক বৈচিত্রের সন্ধান দেয় আমাদের। ধারালো দা আর দড়ি নিয়ে যখন দক্ষ রস সংগ্রাহক এক-পা দু-পা করে এগুতে থাকে তখন বোধ হয় খেজুর গাছের গা জ্বলে। এই বুঝি তার শরীর খুরে বের করা হবে তার সাধনার ধন। অমৃত রস।আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে এই মিষ্টি আর সুপেয় রস হরণ। হরণকারী আর কেউ নন। আমাদেরই পাড়া প্রতিবেশী কেউ হয়তো এই কাজ করেন প্রতিবছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে। তিনি তার সাথে থাকা ধারালো ছুরি বা ছেনি দিয়ে গাছের কোন এক পাশে প্রায় দুই ফুট লম্বা করে লম্ব ভাবে একটি সরল রেখার মতো গর্ত করেন। এতেই বোধ হয় রস্বধারীর প্রাণে বেড়িয়ে যায়। কাটা জায়গাটকে দু-তিনদিন শুকিয়ে এর নিচের প্রান্ত বরাবর একটা চিকন বাঁশের নলা অর্ধ ফালি করে জুরে দেয়া হয়। এর নিচে শক্ত করে বাঁধা হয় চুন মাখানো মাটির হাঁড়ি। খেজুর গাছের জীবনের সব নির্ঝাস রস হয়ে বাঁশের ফালি বেয়ে ফোটায় ফোটায় পড়তে থাকে হাঁড়িতে। দিন আর রাত্রির সমন্বয়ে গড়া সময়ের কোন এক সময় হাঁড়ি রসে টইটুম্বুর হয়। হাঁড়ি সরিয়ে নেয়ার পরও সেখান থেকে রস পড়তে থাকে এক ফোটা আর দুফোটা করে। সেই কয়েকফোটা খাওয়ার লোভে ছোট বেলায় বন্ধুর পিঠে চড়ে যখন মুখ হা করে রস খাচ্ছি, তখন দেখি আমার মতো করে একটি কলা বাদুড়ও রসে চুমুক দিয়ে রেখেছে। তার ঠোঁট ভেজা কতক রসই ফোটায় ফোটায় পড়ছে আমার মুখবিবরে।
ছেলে-বুড়ো থেকে শুরু করে সকলেরেই রয়েছে এই রসরে প্রতি বিশেষ টান। সেই টানে উঠতি বয়সের বালকেরা উঠে যায় খেজুর গাছে। লুকিয়ে লুকিয়ে রস পান করার মাঝে অজানা এক তৃপ্তি নিহীত থাকে। এ কাজে রেকম দক্ষতা আর নৈপুন্যের দরকার তাতে তারা হার মানায় রবিনহুড,টারজান আর স্পাইডারম্যানদের। শীতকালে গ্রামের ছেলেদের এরকম রস পানের অনুশীলন চলে তাদের পুরো শৈশব জুরে। খেজুরের রস আগুনে জাল দিয়ে তৈরী করা হয় মিষ্টি গুর। মাঝে মাঝ খেজুরের রসের শিন্নি রান্না হয় গ্রামের-গঞ্জে,বাড়িতে বাড়িতে।
খেজুরের রস নিয়ে বাংলা সাহিত্যেও কম মাতামাতি হয়নি। অমর কথা সাহিত্যিক জহির রায়হান সামন্য ভেলকি দেখিয়েছেন তাঁর কালজ্বয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’-এর কোন এক পাতায়।রাতের বেলা মন্তুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খেজুরের রস পাড়তে নিয়ে যায় টুনি নামের এক দূরন্ত কিশোরী। নিজের ভাষায় যদি লিখে যাই( পাঠক মহলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)—
শীতের রাত। কন কনে ঠান্ডা। কুয়াশার আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছে। চলমান কুয়াশার শুভ্র পানির কণা চোখের পাতায় লেগে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি শক্তি ঝাপসা হয়ে আসছে মন্তু আর টুনির। একটি খেজুর গাছের নিচে তাদের দু-জোড়া পা থেমে গেল। নির্জন রাতে দুটি প্রাণির বিচরণে আচমকা খেজুর গাছ থেকে পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল কয়েকটি কলা বাদুড়। টুনি পড়নের শাড়িটাকে লুঙ্গির মতো করে এক ভাঁজ দিয়ে কোমড়ের সাথে বেঁধে বানরের মত ওঠে গেল খেজুর গাছে। টুনির পা থকে উড়ো পর্যন্ত অনেকটা আজ উন্মুক্ত। আবছা অন্ধাকরে টুনির পায়ের নগ্ন অবয়ব দেখে মন্তুর বুকে ধম করে কে যেন বাড়ি মারল। ঘুম ঘুম চোখে মন্তুও আর রইলনা। অষ্টাদশী টুনির রিষ্ট পুষ্ট আর রসালো নগ্ন পা যুগল থেকে যেন যৌবনের রস বেরুচ্ছে ছ্যালাৎ ছ্যালাৎ। মন্তু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে টুনির দিকে। জীবনে এমন দৃশ্য হয়তো সে আর দখেতে নাও পারে। কিছুক্ষণ পর টুনি নেমে আসল রস ভর্তি একটি হাঁড়ি নিয়ে। দূর-দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জ থেকে আলোর রেখা আসছে। প্রশস্ত আর খোলা বিলের সিমানা পেরিয়ে সে আলোর রেখা এসে জায়গা পেল মন্তু আর টুনির চোখে।(প্রয়াত জহির রায়হান মোটেও এভাবে লেখেননি। আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তাঁর লেখা অতুলনীয়। আমি শুধু নিজের মতো করে আমার ভাবনা দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে লিখলাম।)
খেজুর গাছ মরু অঞ্চলে জন্মে বেশি। তবে এর চাষাবাদের ইতিহাস নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোয় সর্বপ্রথম এর চাষাবাদ হয়েছিল। সম্ভবত, প্রাচীনকাল থেকেই মেসোপটেমিয়া থেকে প্রাগৈতিহাসিক মিশরের অধিবাসীরা খ্রিস্ট-পূর্ব ৪০০০ বছর থেকে এ গাছের গুণাগুন সম্পর্কে অবগত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা এর ফল থেকে মদজাতীয় পানীয় প্রস্তুত করে ফসলের সময় তা পান করতো। খ্রিস্ট-পূর্ব ৬০০০ বছর আগেকার সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে দেখা যায় যে, পূর্বাঞ্চলীয় আরবেও এর চাষাবাদ হতো।প্রস্তর যুগে পশ্চিম পাকিস্তানের মেরগড় এলাকায়ও খেজুরের চাষাবাদ সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে লিপিবদ্ধ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত ‘হরপ্পা’এলাকার কথা উল্লেখ আছে খ্রিস্ট-পূর্ব ২৬০০ থেকে খ্রিস্ট-পূর্ব ১৯০০ বছর পর্যন্ত।
পুরুষ খেজুর গাছ নারী খেজুর গাছ থেকে বেশী রস দেয়। তার রস স্বাদেও নারী গাছের রস থেকে মিষ্টি।পরিমাণেও বেশি। এখানে আবার সাহিত্যিকদের সাথে জীববিজ্ঞানীদের একটু দ্বিমত হয়ে গেল যে!কারণ সাহিত্যিকেরা ’রস’ বিষয়টি নারীর শরীরের সৌন্দর্যের সাথে সম্পাদন করেন।(সবাই না)। এখানে এর উল্টো।আমারও মাঝে মাঝে ভাবনা হয়। জীববিজ্ঞানীরা আবার খেজুর গাছের লিঙ্গ নির্ধারণে ভুল করে ফেল্লেননাতো? সবাইকে নতুন বছরের খেজুরের রসের রসালো শুভেচ্ছা।
লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ