আবরার থেকে তারা কি শিক্ষা নিল?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হানাহানি অরাজকতা যেন কমছেই না। গত অক্টোবরে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকান্ডের পর জাতি আশা করেছিল এই খুনের ধারা বন্ধ হবে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে অধিক মানবিক হয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানে থেকে তাদের পড়াশোনা, মিছিল মিটিং মুক্ত বুদ্ধিচর্চা চালিয়ে যাবে। কিন্তু কি দেখছি যে লাউ সেই কদু। সেইদিন তো ডাকসুতে দুই একটি লাশ ফেলানোর জন্যই এই বর্বর হামলা। দুজনের আইসিইউতে ভর্তি ও গুরুতর আহতদের দেখে তাই মনে হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির যে পচন ধরেছে সেখান থেকে এখনো বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি।আমি মনে করি এখান থেকে কয়েকটি কারণে বের হয়ে আসা সম্ভবপর হচ্ছে না। প্রথমতঃ জাতীয় রাজনীতিতে
গণতন্ত্র, পরমত সহিষ্ণুতার অনুপস্থিতি। দ্বিতীয়তঃ রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান,ছাত্র সংগঠনকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার। তৃতীয়ত: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে ঘটা ঘটনা তদন্ত না করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দায় মুক্তি। চতুর্থত: অনেকটা রাজনৈতিক দলগুলোর সবুজ সংকেত পেয়ে এরকম ঘটনায় জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকুক এটি আমাদের মন থেকে চাইতে হবে। শুধু মুখে মুখে বললে হবেনা। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ছাপ রাখতে হবে। অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। মঞ্চ নাম দিয়ে যেসব সংগঠন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অতীত ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখকর নয়। গণজাগরণ মঞ্চ উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। গণজাগরণ মঞ্চ এবং এর আধিকারিকরা বর্তমানে ডাস্টবিনে নিক্ষেপিত। যতটুকু জানা যায় গণজাগরণ মঞ্চ এখন তিন টুকরো। এর প্রধান কুশীলব ইমরানকে সামাজিক কোনো অসঙ্গতি কিংবা অনাচারের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী ভূমিকা এখন চেরাগ দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। সময় তাদের ব্যবহার করে এভাবেই ব্লাক হোলে নিক্ষেপ করে। এদিকে কোটা বাতিলের পর কোটা পুনরায় বলবৎ করার দাবিতে প্রায় ১৪ মাস আগে প্রতিষ্ঠিত হয় কথিত মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ।
এই মঞ্চের ঐক্যের আয়ুষ্কাল খুব বেশি স্থায়ী ছিল না। শুরুতে এই মঞ্চের মূল নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান। তবে পরে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে মঞ্চটি দুটুকরো হয়ে যায়।ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অব্যাহতি পাওয়া সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিজেকে সভাপতি এবং ছাত্রলীগের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপ সম্পাদক আল মামুন নিজেকে সাধারণ সম্পাদক ঘােষণা করে।আমিনুল ও মামুনের এই শেষের অংশটি একটি অতি উৎসাহী গ্রুপ। যারা নিজেদের মেলে ধরে নেক নজর পাবার আশায় শোডাউন, ভিন্ন মতের ওপর হামলা করতে পর্যন্ত পিছপা হচ্ছে না। এরাই জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ওপর হামলা করেছে, দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার অফিস তছনছ করেছে এবং এর সাংবাদিককে মারধর করে পুলিশে দিয়েছে। সর্বশেষ ডাকসু ভবনে ভিপি নুরসহ ৩০ -৩৫ জনকে রুমের লাইট নিভিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। কাউকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। একজন লাইফ সাপোর্টে জীবন মৃতুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।এ ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তাদের পাশে থেকে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদকের প্রতিক্রিয়ায় তা পরিষ্কার,নুর আহত নাকি নিহত হয়েছেন, ডাজ নট ম্যাটার। চিন্তা করা যায় ?নুর ও তার সঙ্গীদের যারা পেটালো তারা এতো সাহস কোথায় পেল? এর পেছনে তাদের সাহসের দুটো উৎস রয়েছে, এক. অতীতের অপকর্মের জন্য তাদের বিচার হয়নি। দুই, তারা জানে এসব অপকর্ম করলে অনেকে তাদের বাহবা দেবে, তাদের সাদরে গ্রহণ করবে। এজন্য তারা ছাত্রলীগ ছেড়ে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের ব্যানারে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানোর সাহস পাচ্ছে। এদের অতীতের কার্যকলাপ একটু ঘেঁটে দেখি। তাদের আমলনামায় বা কি বলে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের এক পক্ষের মূখপাত্র অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।তিনি একবার টিএসসিতে ঢাবির প্রক্টরের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এই অংশের আরেক শীর্ষ নেতা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের (এসএম) শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় উপ-পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।দুইজন ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ২০১৭ সালের অক্টোবরে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ছাত্রলীগ থেকেও বহিষ্কার হন। এছাড়া তার নিজের হল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের মারধরসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের যে অংশের তান্ডবলীলায় উদ্বিগ্ন জাতি, যারা ভিপি নুরুল হক ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলায় জড়িত। এবার তাদের সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর দেই। ডাকসুর ঘটনায় সোমবার দিনবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে শাহবাগ থানা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। মামলায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল এবং সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এএসএম সনেট এবং সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্যসহ আরো ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করেছে পুলিশ।
আল মামুনকে ইতোমধ্যে আটক করেছে পুলিশ। মঞ্চের নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, সভাপতি আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্চ সদর থানায় ২০১৬ সালে হওয়া একটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি সে।এছাড়া তার পক্ষের আরেক শীর্ষ নেতা সনেট মাহমুদের বিরুদ্ধে রয়েছে সমকামিতাসহ বিকৃত যৌনাচারের অভিযোগ। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে। হল থেকে বেরও করে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগেরই নেতাকর্মীরা। এ তিনজনই ভিপি নুর ও তার সহযোগীদের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেয়।তবে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধেও নুরকে মারা অভিযোগ রয়েছে। ডাকসু ভবনের ভেতরে ও বাইরে মিলে মোট ৯টি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু নুর ও তার সতীর্থদের উপর হামলার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হয়ে গেছে। কারা গায়েব করেছে তা বলতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।ভিডিও ফুটেজ যে কতটা শক্তিশালী তথ্য প্রমাণ হতে পারে তা বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা কান্ডের পর টের পেয়েছেসন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীরা এটা বুঝেই পরিকল্পিতভাবে ভিডিও ফুটেজ গায়েব করেছে। এই ভিডিও ফুটেজ অপরাধী সনাক্তকরণে মূল ভূমিকা পালন করতে পারতো। গ্রাম বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে।
ঝি কে মেরে বৌকে শেখানো। জাতি স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিল বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার পর অপরাধীরা সতর্ক হবে। আবরারের ঘটনার পর অন্তত শিক্ষাঙ্গণে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ হবে। আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না। আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ ২৫ জনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে । এ হত্যাকাণ্ডে ১১ জনের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং ১৪ জনের সম্পৃক্ততা দেখানো হয়েছে চার্জশিটে। অভিযুক্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেফতার রয়েছে। বাকি চারজন এখনো পলাতক। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ২৫ জনকে আসামি করে দেওয়া চার্জশিট গ্রহণ করেছেন আদালত। এর মধ্য দিয়ে আবরার হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। এই যে একটি জীবন নাশের বিনিময়ে ২৫টি জীবন নষ্ট হলো! এটি কি নোংরা, সন্ত্রাসী রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জন্য কি সতর্ক সংকেত নয়? তারা কি এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে? তারা যদি শিক্ষা নিতো তাহলে ডাকসুর এই হৃদয়বিদারক দুঃসহ ঘটনার পুনরাবৃত্তি তারা ঘটাতো না।