একজন সাহসী ভিসি নাজমা ও আমাদের মেরুদণ্ডহীন ভিসিরা
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৫:৫৪ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:২১ PM
ভারতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে চলছে তুমুল বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। কোথাও কোথাও বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে বাস ট্রেন সরকারি সম্পদ। বিচ্ছিন্ন করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ পর্যন্ত জনা কুড়ি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন কয়েক হাজার। তবুও থেকে নেই বিক্ষোভ প্রতিবাদ। প্রতিদিন বিক্ষোভে পাচ্ছে নতুন মাত্রা।
বিলটি ভারতীয় সংসদে পাসের পর সারা ভারতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ ডিসেম্বর ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত প্রায় একশ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে। নিজেদের ক্যাম্পাসের ভেতর নাগরিকত্ব আইন বিরোধিতায় তারা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রদর্শন করে কিন্তু বিক্ষোভ দমনের অজুহাতে, পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।
দিল্লি-পুলিশ কেবল বিনা অনুমতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে, তা-ই নয়, বরং লাঠিচার্জ করেছে, ছুড়েছে কাঁদানে গ্যাসও। আহত হয় শতাধিক শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তার করা হয় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। পুলিশের টিয়ার গ্যাস এবং লাঠিচার্জে লণ্ডভণ্ড হয়েছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি।
একজন প্রতিবাদী শিক্ষার্থী জানান, ‘আমি তো মুসলিমও নই। তবু প্রথম থেকে প্রতিবাদের পুরোভাগে আছি। কারণ এরাই আমার পরিবার। বন্ধুবান্ধব থেকে শিক্ষক, সবাই।’
জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে অসংখ্য মানুষ শীতকে উপেক্ষা করে মধ্যরাতেই দিল্লি পুলিশের সদর দফতরের বাইরে জড়ো হন। পুলিশি সদর দফতরের বাইরের মূল রাস্তাটি অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান প্রতিবাদকারীরা। পরে ভোরের দিকে আটক করা ছাত্রছাত্রীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৩ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানে মুহূর্তে নেমে আসে কবরের নীরবতা। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঘটনার পরের দিন মাথার উপরে হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে শিক্ষার্থীদের হঁটে যেতে বাধ্য করে পুলিশ।
‘তোমাদের পাশে আছি। তোমরা একা নও।’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি নাজমা আখতারের এই আশ্বাস এখন ভাইরাল। এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং দিল্লি পুলিশের মধ্যে টানাপড়েন চলছেই।
এরমধ্যে মধ্যেই ঘটনার পরের দিন সংবাদমাধ্যমের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখোমুখি হয়ে ভিসি নাজমা আখতার বলেন, ‘‘আমার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পুলিশ যে আচরণ করেছে, তাতে অত্যন্ত আহত আমি। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, এই লড়াইয়ে তোমাদের পাশে আছি। তোমরা একা নও। আমি সঙ্গে রয়েছি। তার জন্য যতদূর যেতে হয় যাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে। কে ক্ষতিপূরণ দেবে? সম্পত্তি নষ্টের চেয়েও বড় কথা হল শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় আঘাত হানা হয়েছে। লাইব্রেরিতে ঢুকে তাদের পেটানো হয়েছে। এর তদন্ত হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পুলিশ যাতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য মামলা দায়ের করব আমরা। সম্পত্তির ভাঙচুর হলে সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব। তবে শিক্ষার্থীদের মনে যে প্রভাব পড়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।’’
ভিসি নাজমার এ বক্তব্য সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসির এমন সাহসী বক্তব্যে এবং দৃঢ়তায় সবাই মুগ্ধ। তিনি এখন সামাজিক মাধ্যম ও জনগণের মুখে মুখে প্রশংসায় ভাসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর ভিসি আদালতের শরণাপন্ন হবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি পুলিশের কাছে লিখিত জবাব চেয়েছিলেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পুলিশকে অনুমতি কে দিয়েছে, সে ব্যাপারে জানতে চান তিনি। বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পাসে কেন প্রবেশ করলো পুলিশ? শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ কেন করা হলো, সেসব জানতে চাওয়ার পরেও থেমে থাকেননি। পুলিশের বিরুদ্ধে ভিসি নিজেই অভিযোগ দায়ের করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে এমন কঠোর পদক্ষেপ নেবে, সেটা হয়তো ভাবতেই পারেনি ভারতের পুলিশ।
সেটাও আবার কোনো নারী ভাইস ভিসি! এখন যৌক্তিক কোনো জবাবও দিতে পারছে না পুলিশ। কর্মকর্তারা একেকজন একেক কথা বলছেন। একজন গণমাধ্যমে বলেই ফেলেছেন, আসলে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে চায়নি, শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিতে গিয়ে দৌড়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হঠাৎ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে।তবে ভিসি নাজমা আকতারের কাছে এমন উত্তর যুতসই মনে তো হয়নিই বরং তিনি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে দিল্লি হাইকোর্টে গেছেন। দায়ীদের তিনি কাঠগড়ায় নেবেনই বলে জানতে চান, কেন ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলা হলো?
নাজমা আখতার বিশ্ববিদ্যালয়টির ৯৯ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী ভিসি। তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। সেখানে তিনি স্বর্ণপদক লাভের পাশাপাশি জাতীয় বিজ্ঞান মেধাবৃত্তি লাভ করেন। তিনি কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়ে কমনওয়েলথ ফেলোশিপ লাভ করেন। তিনি ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নাজমা আখতারকে ভিসি হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নিয়োগদানে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দর কাছে সুপারিশ করলে তা অনুমোদন লাভ করে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে রাষ্ট্রের মধ্যে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার প্রতীক হিসেবে। ভিসি হবেন সাহসী দৃঢ়চেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে ভিসির দায়িত্ব হলো, বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে করণীয় ঠিক করা, শিক্ষা বিষয়ক সেমিনার সিম্পোজিয়াম, বক্তৃতা, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি, গবেষণার মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা দেখা, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি। এগুলোই হওয়া স্বাভাবিক।
কিন্তু এখন আমাদের দেশে নতজানু ভিসি সাহেবানরা ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে, লাল নীল, কালো রাজনৈতিক কালার নিয়ে। ব্যস্ত গুণকীর্তনের কলাম লেখা নিয়ে যেমন পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, সরকারের সাফল্য, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ইত্যাদি। রাতে ব্যস্ত টক শোতে। দিনে মিছিল মিটিং শোডাউন নিয়ে। ইউজিসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন ভিসি দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে আছেন? কয়জন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারবেন? কোনো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লাশের স্তূপ হলেও ভিসি চেয়ার ছাড়বেন না। শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে কয়জন ভিসি দাঁড়ান? দলকানা, দলীয় আনুগত্যের কারণে যেসব ভিসি অন্ধ হয়ে যান, শিক্ষার্থীদের ভালো না বেসে, পাশে না দাঁড়িয়ে পদ আঁকড়ে ধরে রাখতে ভালোবাসেন, সেইসব নতজানু, মেরুদণ্ডহীন ভিসিদের জন্য নাজমা আখতার অনুসরণীয় বটে।তবে নাজমা আখতারের মতো ভিসি বাংলাদেশও পেয়েছিল। এখন শুধুই অতীত।
এখনো যাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়, ড. আর সি মজুমদার (ঢাবি), ড. মুহাম্মদ হোসেন (ঢাবি), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (ঢাবি), ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী (ঢাবি), ড. আবদুল মতিন চৌধুরী (ঢাবি), ড. ফজলুল হালিম চৌধুরী (ঢাবি), ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (জাবি), ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (জাবি), ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ (রাবি), ড. সৈয়দ আলী আহসান (জাবি), ড. মোহাম্মদ হোসেন (কৃষি), ড. ইকবাল মাহমুদ (বুয়েট), ড. এ আর মল্লিক (চবি), ড. ইন্নাস আলী (চবি), অধ্যাপক আবুল ফজল (চবি), ড. আবদুল করিম (চবি), অন্যতম। তারা ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক