২০ ডিসেম্বর ২০১৯, ২১:১৮

অভিশংসন ও টুইট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরিণতি

  © টিডিসি ফটো

আমেরিকা ৪৫ তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে এখন খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ (প্রতিনিধি পরিষদ) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ইতোমধ্যেই অনুমোদিত হয়েছে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ, প্রথমতঃ তিনি তার পদ ব্যবহার করে তার ডেমোক্র্যাট রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ অভিশংসনের তদন্তকাজে সহায়তা করতে অস্বীকার করে তিনি কংগ্রেসের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন।

প্রথম অভিযোগের ক্ষেত্রে ২৩০ ভোট পড়েছে অভিশংসনের পক্ষে এবং বিপক্ষে ১৯৭ ভোট পড়েছে।দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অভিযোগে অভিশংসনের পক্ষে পড়েছে ২২৯ ভোট ও বিপক্ষে ১৯৮ ভোট। জেনে রাখা ভালো যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেস নামে পরিচিত এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস যেখানে বিরোধী দল ডেমোক্রেটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।

এই নিম্নকক্ষে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নাম সিনেট। যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। যে কারণে নিম্নকক্ষ কংগ্রেসে ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রস্তাব অনুমোদন লাভ করলেও সিনেটে সেটি গৃহীত হবার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ১০০ আসনবিশিষ্ট।

এতে বর্তমানে রিপাবলিকানদের আসন আছে ৫৩টি। ডেমোক্রেটদের আসন আছে ৪৭টি। ফলে ধারণা করা হয়, সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় শেষ রক্ষা পেতে পারেন ট্রাম্প। এছাড়া সিনেটে অভিশংসন করতে হলে দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৭ জন সিনেট সদস্যদের সমর্থন লাগবে যা যোগাড় করা ডেমোক্রেটদের জন্য কঠিন হবে। তবে ঘটনা উল্টো ঘটলেও অবাক হবার কিছু নেই।

কেননা বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের মতো ওদের কোনো অনুচ্ছেদ নেই। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লোর ক্রসিং করে পার্লামেন্টে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সিনেটে ২০ জন রিপাবলিকান দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সেক্ষেত্রে সিনেটে অভিশংসনের প্রস্তাব পাস করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিচারের মুখোমুখি করা অসম্ভব কিছু নয়।

রিচমন্ড স্কুল অফ ল’র অধ্যাপক কার্ল টোবাইয়াস বলছেন, এতো ভোট নিশ্চিত করতে পারার সম্ভাবনা কম। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দেয়ার অধিকার রয়েছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। তাদের নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেবার কথা।তবে যাই ঘটুক না কেন জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

অভিশংসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Impeachment. শব্দটির বাংলা অর্থ হলো অভিশংসন, অভিযোগ, ব্যবহার অভিযোগ, সন্দেহ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানকে অভিযুক্তকরণ। সংসদ বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, অক্ষমতা কিংবা জনস্বার্থ বিরোধী অন্য কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করে অপসারণ করাকে বলা হয় অভিশংসন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয় অভিশংসনের মাধ্যমে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, বেশ কিছু অপরাধের জন্যে প্রেসিডেন্টকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া অর্থাৎ তাকে অভিশংসন করা যেতে পারে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেওয়া অথবা অন্য কোন বড় ধরনের কিম্বা লঘু অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, যেখানে আইন তৈরি করা হয়, তারা দেশটির প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে।যেসব কারণে তারা একজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করতে পারে। ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ গ্রহণ, অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের ক্রাইম এবং দুর্ব্যবহারের’ অভিযোগে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অভিশংসনের ঘটনা বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের অভিশংসন মানেই এটা নয় যে এর প্রক্রিয়া শুরু হলেই প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের কারণে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি।

ট্রাম্পের আগে দুবার দুজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের ঘটনা ঘটেছিল। ১৮৬৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কংগ্রেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি সেক্রেটারি অফ ওয়ার বা যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এডউইন স্ট্যানটনকে বরখাস্ত করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারে বাধা দেওয়ার।সেই সময় তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়নি। অল্পের জন্যে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।

একটি মাত্র ভোটের অভাবে তার অভিশংসনের জন্যে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পাওয়া যায় নি। দীর্ঘদিন পর ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধেও নিম্ন কক্ষে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। মিথ্যা কথা বলে শপথ-ভঙ্গ করা এবং বিচারে বাধা সৃষ্টির অভিযোগে তাকে অভিশংসিত করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ১৯৯৯ সালে যখন এসব অভিযোগে উচ্চ কক্ষ সিনেটে বিল ক্লিনটনের বিচার হয় তখন তাকে আর দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি।কারণ এসব অভিযোগের পক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থন পাওয়া যায়নি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন এবং ক্লিনটন যদিও নিম্নকক্ষে অভিশংসিত হয়েছিলেন। সৌভাগ্য তাদের যে সিনেটে অভিশংসিত হয়ে তাদের পদচ্যুত হতে হয়নি।তবে ১৯৭৪ সালে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন।

বলা হয়ে থাকে, প্রক্রিয়াটি শুরু হলে তাকে হয়তো প্রেসিডেন্টের পদ থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে দেওয়া হতো। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রথম ধাপ পেরিয়ে সেটি এখন সিনেটে যাবে। সিনেট যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দ্বিতীয় অংশ বা উচ্চকক্ষ।

এটি অনেকটা আদালত কক্ষের মতো, যেখানে সিনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট দোষী কি নির্দোষ। প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিতে হবে।

প্রত্যেক সিনেটরকে নিজের বিবেকের দ্বারা চালিত হয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তিনি কোন পক্ষে ভোট দেবেন। এরই মধ্যে কয়েকজন রিপাবলিকান ঘোষণা দিয়েছেন যে তারা প্রেসিডেন্টকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যই ভোট দেবেন। আবার অনেক ডেমোক্র্যাট মনে করেন যে এখন পর্যন্ত পাওয়া সব সাক্ষ্য প্রমাণ সাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্ব থেকে অপসারিত হতে পারেন।

অভিশংসনের ব্যাপারে ভোটাভুটির সামনে রেখে নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে ক্ষুব্ধ হয়ে চিঠি লিখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চিঠিতে লিখেন, তাকে অভিশংসনের উদ্যোগ ‘মার্কিন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা’। শুধু চিঠি কেন।ঘন ঘন টুইট করে রীতিমতো সাড়া ফেলেছেন দিয়েছেন ট্রাম্প।

গত রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৩৬৭ বার টুইট পোস্ট করেন তিনি। অভিশংসন নিয়ে শুধু বৃহস্পতিবারেই টুইটারে তার অ্যাকাউন্ট থেকে ১২৩টি টুইট করেন। শুধু যে নিজের লেখা পোস্ট করেছেন তা নয়, অনেক কিছু রিটুইটও করেছেন।

একটি টুইটে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ট্রাম্প লিখেছেন, এটা কোনোভাবেই ঠিক না। কোনো ভুল না করার সত্ত্বেও আমাকে অভিশংসন করা হচ্ছে। দেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক সাফল্য, প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো, কর্মসংস্থান তৈরি আরও কতো কি তৈরি করেছি। আসলেই অদ্ভুত। তবে শিরোনামে পরিণতির যে আভাস দেওয়া হয়েছে সেই পরিণতি হয়তো তাকে ভোগ করতে হবে না। আগের দুজন প্রেসিডেন্টের মতো তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পও পার পাবেন বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক