পতাকা-মানচিত্র পেয়েছি, চাই বৈষম্যহীন রাষ্ট্র
বিজয়ের ৪৮ তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন শোষণের নাগপাশ থেকে ছিন্ন হয়ে অর্জন করলাম বিজয়। তিরিশ লক্ষ শহিদ আর দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আমাদের এই চূড়ান্ত বিজয় ও স্বাধীনতা। দীর্ঘ সাড়ে নয় মাসের যুদ্ধ এক গঙ্গা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই অর্জন। পেলাম লাল সবুজের অহংকারের পতাকা। পেলাম ১,৪৭৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের ভূখণ্ড তথা দেশ।
সত্যিকারের স্বাধীনতা কি পেয়েছি? বিজয়ের অর্ধ শতবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের উপলব্ধি কি? পেরেছি কি শোষণ, বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে? অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কম নয়, মহাকাশ জয় করেছি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে, গড় আয়ু, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছি।
কিন্তু দুর্নীতি, লুটপাটের লাগাম কি টেনে ধরতে পেরেছি? একাত্তরের রাজাকার, দেশবিরোধীরা স্বাধীনতা চায়নি। স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল তারা। আজকের দিনে যারা দুর্নীতি লোপাটে জড়িত তারা ঐসব রাজাকারদের চেয়ে তারা কোন অংশে হীন? তারাতো দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ছে। আবার তাদের মুখেই শুনতেই হয় চেতনার বাণী।
এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেকার ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। যদিও বাস্তবে বেকারত্বের সংখ্যা এই সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। শিক্ষিতদের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ।
জাতীয় যুবনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের শিক্ষিতদের নিয়ে ফেসবুক ও ই-মেইলের মাধ্যমে বিআইডিএস অনলাইন জরিপ পরিচালনা করে। বিবিএসের জরিপের তুলনায় বিআইডিএসের অনলাইন জরিপে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি পাওয়া যায়।গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। এদের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে এবং ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। চাকরি বাজারে হাহাকার। বেকারত্বে শিক্ষিত তরুণরা দিশাহারা। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রায় জনগণের আয়ত্তের বাইরে।
সাম্প্রতিককালে পেঁয়াজ নিয়ে জনগণের অসস্তি নিশ্চয়ই সরকার টের পেয়েছে। মানুষের জীবন যাপন আরো গোছালো ও সুন্দর হতে পারতো, কিন্তু সঠিক পদক্ষেপের অভাবে তা সম্ভবপর হচ্ছে না। আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন আমাদের বড় প্রাপ্তি কিন্তু বাজারের অব্যবস্থাপনা হযবরল আমাদের কাম্য নয়। আমাদের স্বাধীনতার মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৪ সালে অর্থলিপ্সু একদল মানুষের অপরিণামদর্শী লুটপাটে দেশজুড়ে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কাছে হেরে যাচ্ছে যেন সদ্য স্বাধীন দেশ। ভাতের জন্য হাহাকার, মানুষ মরছে অনাহারে তখন কবি রফিক আজাদের তেজস্বী কণ্ঠে ভেসে এলো ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।’ এই কবিতা নতুন মোড়কে বেকার তরুণদের কণ্ঠ উচ্চারিত হচ্ছে, চাকরি দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।
আজ খুন ধর্ষণে দেশটা ছেয়ে গেছে। চার বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা এদেশে নিরাপদ নয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে অবলা নারী সমাজ। সবার আগে প্রয়োজন নিরাপদ জীবন যাপন।কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ প্রতিবাদে লিখলেন,
‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে..
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?’
শুধু পতাকা, ভূখন্ডের পরিবর্তন নয়। চাই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ।খাঁচার পাখিরও যেমন আরাধ্য বিষয় স্বাধীন জীবন তেমনি পাকিস্তানের জিঞ্জিরে বাঙালি চেয়েছিল সেই মুক্ত আকাশ নামের স্বাধীনতা।
‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব- শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।’
আমাদের পবিত্র সংবিধান ৩৯ নং ধারায় বাকস্বাধীনতা দিয়েছে। সেই বাকস্বাধীনতা প্রকাশ করতে গিয়ে নাগরিক সমাজ ও সাধারণ জনগণ আতঙ্কিত। কী বলতে গিয়ে তারা আবার কি বলে মুসিবতে পড়েন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয় কিনা?নানান সাত সতেরো চিন্তা। আইসিটি আইন তো ঝুলছেই। এদেশের জনগণ দুমুঠো আহার করে চায়ের টেবিলে বা হাটবাজারে গালগল্প করতে বেশ পছন্দ করেন।
কিন্তু জনগণের মধ্যে সেই গল্প এখন তিরোহিত। সামান্য কিছু গল্প বা সরকারের সমালোচনা করলেও তা অতি সাবধানে করে থাকেন। পাছে লোকে শোনে যদি প্যাচ লাগিয়ে দেয় এই দুশ্চিন্তায় তারা ভীতসন্ত্রস্ত। এবার রাশিয়ার একটি পুরোনো গল্প বলি। রাশিয়ায় যোশেফ স্টালিনের সময় নাকি নির্যাতন, নিপীড়নের মাধ্যমে হত্যা করা হয় প্রায় ২ কোটি মানুষকে। এদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহবশত, সরকারের সমালোচনা ও সরকার বিরোধী ভূমিকার কারণে।
জানা যায় সন্দেহের শিকার অনেকেই স্টালিনেরই অন্ধ ভক্ত ছিল। স্টালিন তার মৃত্যুর সময় কোনো চিকিৎসা পাননি শুধু এইজন্য যে, কোনো ডাক্তার সন্দেহের আওতায় পড়ার ভয়ে তার চিকিৎসা করার সাহস পাননি। মৃত্যুর পূর্বে দীর্ঘসময় তাই অচেতন পড়ে থাকতে হয়েছিল স্টালিনকে।স্টালিনের এসব অপকর্মের সহযোগী ছিলেন অশিক্ষিত নিকিতা ক্রুশ্চেভ যিনি খনি শ্রমিক হতে পরবর্তীতে রাশিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব হয়েছিলেন। স্টালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ একবার বলশেভিক পার্টির সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন । ভাষণে তিনি স্টালিন এর অপকর্মগুলি তুলে ধরে স্টালিনকে খুব গালিগালাজ শুরু করেন।
এসময় উপস্থিত একজন কর্মী চিৎকার দিয়ে বললো- আপনিতো তখন তার সহযোগী ছিলেন। কেন তখন তাকে এসব বলেননি? ক্রশেভ তখন বললেন- কে? কে করেছে এই প্রশ্ন? এত বড় সাহস? সভায় সবাই তো রীতিমতো চুপচাপ, পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। এসময় স্টালিন নিজেই মুখ খুলে বললেন। এই যে আপনারা আমার বন্দুকের গুলির ভয়ে চুপ করে আছেন।
আমিও তখন স্টালিনের গুলির ভয়ে চুপ থাকতে বাধ্য ছিলাম। গল্পের সবটা না মিললেও খানিকটা আমাদের সঙ্গে মিলে যায়। বিজয়ের এতো বছর আমাদের ভাবনা জগতের পরিবর্তন প্রয়োজন। নিজেদের রাজা না ভেবে প্রজাদের কল্যাণে নিবেদিত হই।
আমরা ভূখন্ড, মানচিত্র, পতাকা পেয়েছি এখন চাই পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা নয়, যে স্বাধীনতা যা খুশি তা করার অনুমতি দেয়। আমরা চাই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, কথা বলার, মতামত দেওয়ার, ভালো ভাবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। বিজয়ের ৪৮ তম বর্ষে এই হোক আমাদের একমাত্র চাওয়া।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক