আজ আমার জন্মদিন: আরও একটি বছর গত
আজ আমার জন্মদিন। একটা সময় ছিল এই দিনটি মনেই থাকত না। বন্ধু বান্ধব এবং গুরুজনরা কথার ছলে বলতেন, কিরে আজ তোর জন্মদিন না! আসলে আমরা ভাইবোন ছিলাম চারজন। বাবা আমাদের নিয়ে খুব কষ্ঠে ছোটখাট একটা চা দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। এ সময় আমরা ঘটা করে জন্মদিন করা বা জন্মদিন নিয়ে উইস করা সম্ভব ছিল না। বন্ধুদের জন্মদিন পালন করে ভাবতাম যদি আমার পরিবারও তাদের মত হতো তাহলে আমিও পারতাম। কিন্তু বাবাকে নিয়ে সবসময় অহংকার করতাম। কারণ তিনি সবসময় সৎপথে চলতেন। আর আমাদেরকেও সৎ পথে চলতে অনুপ্রেরণা দিতেন।
বাবা সব সময় একটা গল্প বলতেন, একটা ছেলে পাহাড়ের চূড়া থেকে আসার সময় একটা ঈগলের ডিম খুঁজে পায়। সে ডিম নিয়ে আসে এবং তার খামারের মুরগির ডিমের সাথে রেখে দেয়। নির্দিষ্ট সময় পর, ডিম থেকে ঈগলের বাচ্চা বেড়িয়ে আসে এবং মুরগির বাচ্চাদের সাথে বড় হতে থাকে। ঈগল বড় হতে হতে মুরগি যেভাবে জীবনযাপন করে। ঠিক তেমনটাই করতে লাগলো। সে সারাক্ষণ এখানে সেখানে খাবার বা কীটপতঙ্গ খুঁজে খায়। উড়ার চেষ্টা করে ও কিছু ফুটের বেশি যেতে পারতো না। যেমনটা মুরগি করে। আরও বেশ কিছুদিন পর ঈগলটা বয়স্ক হতে থাকে। একদিন সে আকাশে কিছু একটা দেখতে পেলো। মেঘের মধ্যে থেকে একটা পাখি খুব ক্ষিপ্র গতিতে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওটা কি? অবাক হয়ে ঈগলটি জিজ্ঞেস করল।
একটি মুরগি জবাব দিল- এটা ঈগল। সেই সকল পাখিদের রাজা। পুরো আকাশ তার রাজত্ব। আমরা শুধু মাটিতে থাকি। কারণ আমরাতো কেবল মাত্র মুরগি। তুমি ওটার কথা চিন্তা করো না। আমরা কখনো ওদের মত বিশাল আকাশে উড়তে পারবো না। সেই ঈগলটি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুরগির মত জীবনযাপন করেছিলো। কারণ সেই মেনেই নিয়েছিল তার জিবন আর মুরগির জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তোমরা হয়তো নিজেও যানো না। তোমাদের আশেপাশে মুরগির মত এমন কিছু মানুষ আছে। যারা তোমাদেরকে নিজেদের অবস্থান থেকে এগোতে দিবে না। তারা এই অনুপ্রেরণা দিবে না যে তোমরা মুরগির মত নয় ঈগলের মত ও চলার যোগ্যতা রাখো। তাই তোমাদেরকে সৎ এবং সঠিক মানুষটিকে খুঁজে নিতে হবে। একই সাথে নিজেদের অবস্থানও। তোমাদেরকে তাই করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে যার জন্য এই পৃথিবীতে এসছো। আমারা দুই ভাই সব সময় এই গল্পটা অনুসরণ করে চলি।
এখন প্রায় দেখি আমাদের ছোট ভাই বোনেরা ঘটা করে জন্মদিন পালন করে। কেক না আনলে কেঁদে কেটে অস্থির। আর জন্মদিনের কথা যদি ভুলে যাই, তাহলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। যতই রাত হোক খুঁজে কেক এনে দিয়ে তবে রক্ষা। ছোট ভাইবোনের সাথে জন্মদিন নিয়ে আহলাদ করতে করতে নিজের জন্মদিনটিও এখন স্মরণ রাখার অভ্যাস হয়ে গেছে। আসলে এখনও বন্ধু বান্ধবরাই স্মরণ রাখে। আমার ভাইয়ের ছোট মেয়েটি ও স্মরণ রাখে। আরও আমাকে বাবা বলেই ডাকে। আসলে শিশুদের আদর করলে তারাও অনেক ভালোবাসি। যাইহোক ওর আম্মু বলে– যাও বাবাকে হেপি বার্থডে বল। মেয়েটি গলায় জড়িয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে হে-পি বা-ডে।
আমার সহপাঠীদের থেকে জন্মদিনে উপহারসহ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হত। অফিসে ঢুকেই দেখতাম জন্মদিনের উপহার সম্বলিত শুভেচ্ছা বাণী। বড়ই পুলক অনুভব করতাম। আজকাল ফেসবুক, ব্লগ এসবের বদৌলতে জন্মদিন কথা স্মরণ না থাকলেও স্মরণ করতে বাধ্য। ফেসবুক খোলার সাথে সাথে বন্ধুদের অগণিত উইসভরা মেসেজ আপনাকে জানিয়ে দেবে এই বেটা তুই আজকের দিনে জন্মেছিস।
জম্ম হল মানুষের পৃথিবী জীবনের শুরু। ১৯৯৮ সালের এই দিনে বিজয়ের মাসে আমার জন্ম। জীবনে চলার পথে হোঁছট খেতে খেতে, বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গাতে ডিঙ্গাতে ক্লান্ত আমি হতাশা ঘিরে ধরা এক মানুষ আমি। আপনাদের সকলের ভালোবাসা, আন্তরিকতা আর আমাকে নিয়ে আপনাদের চাওয়া পাওয়া, আজ আমাকে নতুন উদ্যোমে চলার প্রেরণা যুগিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার অগোচরে আমাকে ভালোবাসার অনেক মানুষ আছেন। যাদের নাম না বললেই নয়-আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. মাহফুজুর রহমান স্যার। যিনি সব সময় আমাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। স্যার আমার জন্য আইডল। আমার ভার্সিটির অত্যন্ত কাছের বন্ধু আছমা যে আমাকে সব সময় জীবন চলার পথে চলতে সাহস জোগায়। এছাড়াও নাইমা, জুলিয়া, নিশি, তানহা, মাহিদ, শামীম, রবিন, মিশকাত, সম্পদসহ আরও অনেকে আমার অজান্তে আমাকে কল্যাণ প্রার্থনা করছে। আর একটা মানুষের কথা বলতেই হয়। যার নাম মনি। সে আমার একদম কাছের মানুষ। সবসময় আমাকে কেয়ার করে, সুখে দুঃখে পাশে থাকে। আমার সকল ছাত্র, হাজারো বন্ধু, শত আত্মীয়, অজানা শুভাকাঙ্ক্ষী আমার সাফল্য দেখতে উন্মুখ হয়ে বসে আছেন।
জন্ম ব্যাপারটাকে যত খুশির বলে মনে করা হয়, আসলে তা তেমন খুশির নয়। জন্ম হওয়া মানে মৃত্যু ফলে বিজ বোনা। আর মৃত্যুর কথা স্মরণ হলেই মন খারপ হয়ে যায়। এই বুঝি আজরাইল হাজির হইল। খালি ভয়। অবশ্য আল্লাহ ও তার রাসূল (সা) মৃত্যুকে স্মরণ করতে বলেছেন বেশী বেশী। এতে মন নরম হয়। জগতের প্রতি মোহ থাকে না।
পছন্দ অপছন্দ যাই করি না কেন এটা চির সত্য প্রত্যেকটি আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাধ পেতে হবে। বর্তমান মানব সম্প্রদায় এই চির সত্যকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করছে। আর জন্য তারা গা ডুবিয়ে দিচ্ছে নানা ধরনের বিলাস বাসনায়। কিন্তু মৃত্যুকে ভুলে থাকলেই কি সব সমস্যার সামাধান হয়ে যাবে। জন্মদিনের এতো আনন্দ কেক কাটা হুল্লোড়ের মাঝে ভুলে যাই- আমার জীবন থেকে খসে পড়ল আরো একটি বছর। ঝড়ে যাচ্ছে বছরগুলো এক এক করে। হায়াত কমছে।
পবিত্র আলকোরআনে জম্মানো কারন হিসাবে বলা হয়েছে ইবাদতে কথা। অর্থাত আল্লাহর আরাধনা করার জন্যই প্রানের সৃষ্টি। প্রতিটি প্রানীই তার নিজস্ব ঢংগে আরাধান করে। কিন্তু মানব সম্পদায় তার আরধনা দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করেনা। সে ভুলে থাকতে চায় মুত্যর মত তার জম্মের উদ্দেশ্যকেও। জম্ম –মৃত্যু যতই ভাল বা খারাপ হোক না কেন, মনে রাখতে হবে জম্মের মাধ্যাম বান্দার পরিক্ষার হলে প্রবেশ। মৃত্যর মাধ্যমে পরিক্ষার সমাপ্তী। পরীক্ষার হলে বসে বসে কেউ যদি না লেখে সময় ন্ষ্ট করে সে হবে ক্ষতিগ্রস্থ। তেমনি দুনিয়াতে যতক্ষন থাকা হবে ততক্ষন যদি মানুষ ভোগবিলাসে কাটিয়ে মূল্যবান জীবন নষ্ট করা হয় তাহেলে একইরকম ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আমরা দুনিয়াতে আমলে সলেহ করলে অর্থাৎ সৎ কাজ করলে একদিকে আল্লাহর ইবাদত হত অন্যদিকে মানুষের খেদমত হত। হক্কুল ইবাদ অর্থাৎ মানুষের হক যে আদায় করে সে আল্লাহর খুব পছন্দের। এই মানবিক চেতনা মানুষকে দিতে পারে শান্তির ফুলগুধারা। মানবজাতি যদি মনে রাখত তাকে একদিন তার স্রষ্টার সাথে মিলিত হতে হবে। তখন এই ভাল কাজই তার মুক্তির উছিলা হতে পারে। তাই বেশী বেশী মৃত্যুকে স্মরণ করে ভালে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
আমারা দুনিয়ার সবাই যদি মুত্যকে স্মরণ করতাম তাহলে সমাজে পাপ অনেক কমে যেত। মৃত্যু মানে হলো আল্লাহর কাছে জবাবদিহি দেয়া। দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র (আল হাদিস)। শস্যক্ষেতে এখন যদি ভালভাবে কাজ করি আখেরে ভাল ফসল পাওয়া যাবে। আর তা না হলে সর্বহারা হয়ে কেয়ামতের ময়দানে আহাজারী করতে হবে। তাই সকলকে বলবো জন্মদিনে শপথ নিন এখন থেকে জীবন সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করব।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী