শিক্ষকদের পদমর্যাদার উন্নতি ছাড়া শিক্ষার মান বাড়বে না
- তৌহিদুজ্জামান
- প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১০:২০ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:৪০ PM
শিক্ষক শব্দটি যেমন মহান তেমনি শিক্ষকতা পেশাটাও মহান। জাতি গড়ার মূল কারিগর হিসেবে যাদের ভূমিকা থাকে সবার অগ্রগামী তারা হচ্ছে শিক্ষক সমাজ। প্রবাদে আছে– যে জাতি বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। একমাত্র শিক্ষাই পারে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা ছাড়া দেশের উন্নতি কামনা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয় আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশাকে অনেকেই হেয় চোখে দেখে। তাই এই পেশাতে মেধাবীদের বিচরণ দেখা যায় না অথবা কম দেখা যায়। কিছু মেধাবী থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত সুযোগের অভাবে মেধাবীরা তাদের মেধার পরিচয় দেওয়ার সুযোগ পায় না অথবা তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা সব শিক্ষার মূল ভিত্তি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়তে ১ জুলাই ১৯৭৩ সালে এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়তে তারই সুযোগ্য তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে আরো প্রায় ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। এই জাতীয়করণের ফলে প্রাথমিক শিক্ষকেরা সরকারি মর্যাদা পেলেও তাঁরা অনেকাংশে অবহেলিত এবং নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার।
২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তা কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না? পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতন ধাপ আপগ্রেড করা প্রয়োজন। তাদের বেতনগ্রেড ও আপগ্রেড করা হচ্ছে না। যার কারণে এই পেশায় নিয়োজিত সবার মাঝে এক ধরণের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দুঃখ বা ক্ষোভ থাকলে সঠিকভাবে কোন কাজে মনোনিবেশ করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকও কর্মরত রয়েছেন। যোগ্যতা ভিত্তিক স্কেল পাওয়া প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রাণের দাবি। প্রাথমিক শিক্ষকদের পাঠদান ছাড়াও বিভাগবহির্ভূত অনেক কাজ করতে হয়।
বিদ্যালয়ে রুটিন মাফিক কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হচ্ছে। অথচ শিক্ষকদের ন্যূনতা সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। যার কারণে শিক্ষকেরা তাদের কাজের আগ্রহ হারাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে প্রকারান্তে আমাদের দেশই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, সময়সূচী, সিলেবাস, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন-পদমর্যাদা, পদোন্নতি যে দিক থেকেই তুলনা করা হোকনা কেন, ফলাফল একটাই আসবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকরা সবচেয়ে অবহেলিত। তাহলে শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলিত রেখে কীভাবে দেশের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার স্বপ্ন দেখা হয়?
সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করলে হলে শিক্ষকতা পেশাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর তা না করতে পারলে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে আমি মনে করি। যতটুকু জানি শিক্ষকতা পেশায় যারা নিয়োজিত আছে তারা কেউই তাদের প্রাপ্য সম্মান ও পদমর্যাদা নিয়ে খুশি নয়। বিশ্বের উন্নত দেশের দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায় তারা শিক্ষার কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে অথবা তাদের কাছে শিক্ষকের সম্মান কতটুকু। কিন্তু আমাদের দেশে উন্নত দেশ গড়ার ইচ্ছা আছে কিন্তু যাদের দ্বারা এই কাজ সবচেয়ে সুন্দর ও সুচারুভাবে করা যায় সেই জাতিকেই মানের দিক থেকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে।
উন্নত দেশে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয় অথচ আমাদের দেশে ঠিক তার বিপরীত। ফিনল্যান্ড, সিংগাপুর, জাপান, মালয়েশিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবস্থা যাচাই করলে আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলেও আমাদের প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান আমাদের দেশের থেকেও অনেক উন্নত।
আমাদের দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা জেলা শিক্ষা অফিসারের সমান গ্রেডে বেতন পেয়ে আসছেন। সহকারী শিক্ষকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেতন পান।
অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ব্যাপারে শিক্ষা বিভাগের নজর নেই। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক শিক্ষকদের কাজের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু না বাড়ছে তাঁদের মর্যাদা, না বাড়ছে সুযোগ–সুবিধা। এভাবে শিক্ষার ভিত্তি দৃঢ় হতে পারে না।
আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদেরতো উপরতলার অনেকে শিক্ষকই মনে করে না, প্রাথমিক শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশাকে অবমূল্যায়ন করে নাক ছিটকায় অথচ দেশের সর্বাধিনায়ক মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে শুধু নিজের নাম দস্তখত করা একজন সর্বনিম্ন ব্যক্তিও একদিন এই প্রাথমিক শিক্ষকদেরই শিক্ষার্থী ছিল। নিম্ন আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদার কারণে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা কখনো আকৃষ্ট হয়না, তারপরও যারা আসে তাদেরকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন না করার কারণে তারাও এ পেশা থেকে পালানোর চেষ্টা করে, আর যারা এ পেশা ছেড়ে যেতে পারেনা, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে তারাও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায়।
অথচ মানুষ গড়ার আসল কারিগর হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন পদমর্যাদা হওয়া উচিত অন্য পেশাজীবীদের থেকে বেশী। কিন্তু অন্য পেশাজীবীদের থেকে বেশী হওয়াতো দূরের কথা বরং শিক্ষকদের বেতন-পদমর্যাদা তাদের সম যোগ্যতার অন্য পেশাজীবীদের থেকে অনেক কম।
বিসিএস নন-ক্যাডার থেকে সুপারশিকৃত অন্য পেশাজীবীরা সরাসরি ১০ম গ্রেডে নিয়োগ পেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানকৃত প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন ১২তম গ্রেডে। প্রাথমিক শিক্ষা যদি সত্যিকারে শিক্ষার ভিত্তি হয় ও শিক্ষকরা যদি সত্যিকারে মানুষ গড়ার কারিগর হয় তাহলে কেন প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষকরা এত অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার? এভাবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি আর বেশী দিন অবহেলা চলতে থাকলে দেশ ও জাতি ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ যোগ্যতা স্নাতক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম যোগদানের সময় সহকারী শিক্ষকেরা ১৫তম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকে।
এসব শিক্ষকেরা নিয়োগ পাওয়ার পরে প্রত্যেক শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর ডিপার্টমেন্টের অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে দেড় বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারী এডুকেশন নামে একটি অত্যাধুনিক ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। স্নাতক+ডিপ্লোমাধারী হয়েও একজন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক বেতন পান ১৪তম গ্রেডে। অথচ এসএসসি অথবা এইচএসসির পরে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে অন্য সকল ডিপ্লোমাধারীরা বেতন পাচ্ছেন ১০ম গ্রেডে। এটা কি বৈষম্য নয়? অথচ প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে ১১তম গ্রেডের জন্য আন্দোলন করে আসলেও তাদের দাবী এখনও পূরণ করা হয়নি বরং এটা নিয়ে একের পর এক তালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ চলছে।
শিক্ষায় মানোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর তার প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার প্রথম ধাপ। বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করে আমার মতো হাজারো শিক্ষক। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী।
“শিক্ষার ভিতকে মজবুত করুন,
মেধাবীদেরকে এ পেশায় আসার সুযোগ দিন।”
লেখক: প্রধান শিক্ষক, ১০১ নং পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিনাইদহ