আসুন ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে দাঁড়াই
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:২১ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:৪৪ PM
একসময়ে চলচ্চিত্র জগতে সাড়া জাগানো নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এখন আর ঢালিউডে অভিনয়ে নিয়মিত নন। তিনি এখন এদেশের মানুষের হৃদয়ের নায়ক বনে গেছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাঁর ২৬ বছরের আন্দোলন যখন পূর্ণতা পেতে চলেছে তখন সুযোগ সন্ধানী কিছু পরিবহন শ্রমিকের তিনি চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন।
গত ১ নভেম্বর থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইন প্রণয়নে সরকারে সহযোগী হিসেবে ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এই নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকরা কর্মবিরতিও পালন করেছে। শুধু তাই নয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বাস-ট্রাক শ্রমিকরা যে ‘কর্মবিরতি’ পালন করেছেন, সেখানে নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি সম্বলিত ব্যানার টাঙিয়ে কোথাও কোথাও কুশপুত্তলিকা তৈরি করে সেখানে জুতার মালা দেয়া হয়েছে। তার ছবি পুড়ানো হয়েছে।তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রিয় তারকা ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে দেশের লাখ লাখ মানুষ দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিও দাঁড়িয়েছে এই নায়কের পাশে। ব্যক্তিগতভাবে কিছু তারকারাও ইলিয়াস কাঞ্চনের অপমানের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী নতুন সড়ক পরিবহন আইন খতিয়ে দেখার জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হবে। আসলে এ বিষয়ে যদি ছাড় দেওয়া হয় তাহলে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হবে না। হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলতে থাকবে, ঘটবে প্রাণহানি। শক্ত আইন ও এর প্রয়োগই পারে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থার লাগাম টেনে ধরতে। আজকে যখন এ লেখা লিখছি তখনো মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বাস ও মাইক্রোর সংঘর্ষে ৮ জন বরযাত্রী নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৭ জন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে মতে, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ঘ ৭ হাজার ২২১ জন মানুষ নিহত হন। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালে সারা দেশে তিন হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় চার হাজার ৪৩৯ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমতির দিকে ছিল। ২০১৪’র পর থেকে এই সংখ্যা আবার বাড়তে থাকে।বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষে মৃত্যুহার ছিল ১৪.১, যা ২০১৫'তে কমে দাঁড়ায় ১২.৮ এ। তবে এই সংক্রান্ত সাম্প্রতিকতম তথ্য পাওয়া যায়নি। ঢাকার জনপ্রিয় একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে আসে যে গত সাড়ে তিনবছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার মানুষের। বাংলাদেশে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা বিশৃঙ্খল এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ, রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসগুলোতে যা ভয়াবহ দৃশ্যের মতো। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮-র জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৫ হাজার মানুষ এবং আহত প্রায় ৬২ হাজার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে; ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।
ইলিয়াস কাঞ্চনের কেন এই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন? এখানে বলে রাখা প্রয়োজন ১৯৮৮ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। পরবর্তীতে আরেক ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় তার সুখের সংসার। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে নিহত হন ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রিয়তমা স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। জীবনের এই দুটো দুর্ঘটনা তার জীবনের মোড় পাল্টিয়ে দেয়। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে উদ্বুদ্ধ করে, সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের চেয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা হয়ে উঠে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয় সেই লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেন নিরাপদ সড়ক চাই দাবিতে আন্দোলন। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালে ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই' (নিসচা) নামের এই সংগঠন।
মূলত: সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনটির। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সংগঠন দেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনে ধন্য হয়ে উঠে। চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন চষে বেড়িয়েছেন এদেশের পথ ঘাট, কথা বলেছেন মানুষের সঙ্গে। জনমানুষের সঙ্গে মিশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন।
তিনি ধরণা দিয়েছেন সরকারি দল, বিরোধীদল, বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিরাপদ সড়ক ইস্যুতে। সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বিএফডিসি) থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই' শীর্ষক এক পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। এতে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় জনমানুষের অংশগ্রহণ ঘটে। এরপর এ আন্দোলন নিয়ে আর পিছনে ফেরে তাকাতে হয়নি ব্যাপক কর্মতৎপরতায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পেয়েছে যথেষ্ট পরিচিতি। নিরাপদ সড়ক চাই। এখন একটি সফল সামাজিক আন্দোলনের রূপ লাভ করেছে। প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে ২২ অক্টোবর জাতীয় পর্যায়ে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে দিবসটি পালনের আবেদনও জানানো হয়েছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয় ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত সংঘটিত একটি আন্দোলের মধ্যে দিয়ে। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের রেষারেষিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুইজন শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরো কিছু দুর্ঘটনা ফলে বাধ্য হয় সরকার নতুন আইন করতে।
এই নতুন সড়ক পরিবহন আইন ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে নিরাপদ সড়ক চাই দাবিতে আন্দোলন ও সাধারণ জনগণের সমর্থনের ফসল। এ আইন পরিবহন শ্রমিকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো রোধ ও দানবীয় ভূমিকা পরিহার করে মানবীয় হবার জন্য উৎসাহ দেবে। এই আইন পরিবহন শ্রমিকদের মনঃপুত নয় তাই তারা এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অবলীলায় সড়কে অবাধ দুর্ঘটনা ঘটাতে চায়। তাই তারা এ আইন গড়ার নেপথ্যের নায়ক প্রিয় তারকা ইলিয়াস কাঞ্চনকে নাজেহাল ও অপমানিত করতে চায়। ইলিয়াস কাঞ্চনের এই দুঃসময়ে আমাদের উচিত তার পাশে থাকা। ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, আইনের কোন বিষয় নিয়ে ছাড় দেয়া ঠিক হবেনা। “এবার যদি আমরা হেরে যাই, তাহলে হেরে যাবে পুরো বাংলাদেশ।”
আসুন নিজেদের উদ্ভাসিত করি রজনীকান্ত সেনের কবিতার রঙে।
“নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান,
স্বর্ণ করে নিজরূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজস্বরে অপরে মোহিত,
শস্য জন্মাইয়া, নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত-তরে।”