গণঅভ্যুত্থানের ভিসি কি পদত্যাগ করবেন?
বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অরাজকতা চলছে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ এখন ভিসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গাছ কেটে হল নির্মাণের প্রতিবাদে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তীতে শাখা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে ভিসি ঈদ সেলামি দিয়েছেন বলে পত্রিকায় খবর বেরুলে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। অভিযোগটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প থেকে চাঁদা দাবি করেন ছাত্রলীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। ভিসিও তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিলো। তার কয়েকদিন পরই ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে সংগঠন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এসব খবর প্রকাশের পর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে প্রায় দু’মাস ধরে আন্দোলন করে আসছে। গত মঙ্গলবার এ আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। যখন ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারী ৩৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হন। এ হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী চরম নিগ্রহের শিকার হন। এ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অস্থিরতা। এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এক মাস ধরে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা ১১ দিন ধরে উপাচার্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। দুটো হলের শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। অন্যদিকে প্রথম বর্ষে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান, সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করা এবং বিতর্কিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত না রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মঙ্গবার পুলিশ, ভিসিপন্থী শিক্ষকদের সামনেই আন্দোলনকারী শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।সেদিন ভিসি বিরোধী কর্মসূচিতে অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ।দুপুরে আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে বাসভবন থেকে অবরুদ্ধ ভিসিকে বের করে আনেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। পরে ভিসি ফারজানা ইসলাম সাংবাদিকদের সামনে ছাত্রলীগের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগ এতোদিন ধরে ধৈর্য রেখেছে। ওরা কিন্তু তখন মাঠে নামেনি। কিন্তু শিবির যখন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে, তখন আমি মনে করি ছাত্রলীগ যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে। ভিসির বক্তব্যে শিবিরভূত ভর করার পর ক্যাম্পাসে শিবির সন্দেহে তিনজন হিন্দু ছেলেকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। শুধু কি তাই? অবরুদ্ধ দশা থেকে ছাত্রলীগ ভিসিকে বের করে আনার পর, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকে ‘গণঅভ্যূত্থান’ বলে আখ্যা দেন।
ভিসি ওই সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের মহৎ (?) কাজের জন্য ধন্যবাদ জানান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে কয়েকটি প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে। এক: ঈদ সেলামির জন্য যদি ছাত্রলীগের শীর্ষ পদের দুজনের পদ হারাতে হয়। তাহলে ভিসি ফারজানা এখনো কেন স্বপদে বহাল? দুই: দুর্নীতির খবর পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে, সত্যিই যদি তিনি দুর্নীতি না করে থাকেন তাহলে ভিসি আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? তৃতীয়ত: জাহাঙ্গীরনগরের এই ঘটনায় হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী কেন আন্দোলনকারীদের হুশিয়ারি দিলেন? শোভন রববানীর বিরুদ্ধে কেন এতো কঠোর হলেন ইত্যাদি? ভিসির দাবি এ আন্দোলনের পেছনে হয়তো এক বা দুই পার্সেন্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে। এরা কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়। এরা হঠাৎ কতগুলো মানুষ জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নানাভাবে অস্থির করে তুলেছে। প্রশ্ন হলো- সবাই মিলে আন্দোলন করলেই কি একজন মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যায়? আবার দু’একজন আন্দোলন করা মানে সেকি নিরপরাধ এমনটা ভাবার হেতু নেই। আসলে দুর্নীতিগ্রস্ত কেউ কখনো নিজেকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে স্বীকার করতে চায় না। নিজেকে সদা নিষ্কলুষজ্ঞান করেই থাকেন। সমাজ-রাষ্ট্র বিষয়টি জানলেও কখনো কখনো তা অগোচরে থেকে যায়। ফলে দুর্নীতিবাজও খ্যাতি পান ভালো বাবা ও সাদা মনের মানুষ হিসেবে।
তবে আন্দোলন ও পদত্যাগের বিষয়ে গণমাধ্যম এক সাক্ষাৎকারে ভিসি ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘পদত্যাগ করতে হয়, তাহলে জোরালো ঘটনা লাগবে, জোরালো প্রমাণ লাগবে। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট একটি কৌতুক নিবেদন করছি। গল্পটা হলো- সেলুনে চুল কাটাতে গেছেন এক নেতা। নাপিত কাঁচি চালাতে চালাতে বলছেন, ‘স্যার, শুনলাম জনগণ নাকি আপনার ওপর খুব খ্যাপা। যেকোনো দিন আপনার বাড়িতে হামলা চালাইবে! আপনি নাকি ঘুষের টাকা দিয়ে সম্পদের পাহাড় বানাইছেন…।’ নেতা ধমক দিকে বললেন, ‘এই ব্যাটা, চুপ থাক।’
পরদিন নাপিতের কাছে চুল কাটাতে এলেন এক সরকারি কর্মকর্তা। নাপিত তাঁর চুল কাটতে কাটতে বললেন, ‘স্যার, দুদক নাকি আপনারে খুঁজতেছে! যেকোনো দিন ক্যাক কইরা ধইরা জেলে ঢুকায় দিব! আপনি নাকি দুর্নীতি করেন!’ সরকারি কর্মকর্তাও নাপিতকে ধমক দিয়ে চুপ করালেন।
কয়দিন বাদেই নাপিতের দোকান ঘেরাও করল পুলিশ। নাপিতকে আটক করে বলল, ‘এই ব্যাটা, তুই নাকি তোর কাস্টমারদের আজেবাজে কথা বলিস? তোর উদ্দেশ্য কী?’ নাপিত আমতা আমতা করে বললেন, ‘স্যার! এসব কথা বললে ভয়ে ওনাদের চুল খাড়া হয়ে যায়। আমার চুল কাটতে সুবিধা হয়। তাই বলি!
এ কৌতুকের মত রাঘব বোয়াল সব অধরা থেকে যাবে, মাঝখানে ধরা পড়বে নাপিতের মতো চুনোপুঁটি। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ চেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। প্রমাণ দিতে না পারলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে সতর্ক করেছেন। যদিও আন্দোলনকারীরা প্রমাণ দিতে প্রস্তুত।
আবার সেই প্রসঙ্গে আসি। অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে সংবাদ সম্মেলনে ভিসি বলেছিলেন, ‘আমার জন্যে এটা অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন। এই কারণে যে, কোনো প্রমাণ দেখাতে না পেরে মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে যথেষ্ট অপদস্থ ও অসম্মান করা হয়েছে। আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। আমার সহকর্মী-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব ছাত্রছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রলীগের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ তারা দায়িত্ব নিয়ে আমাকে মুক্ত করেছে। এখন সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সবাই আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন। এসব বক্তব্য ও প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর গণঅভ্যুত্থানের ভিসিকে আপাতত সরে দাঁড়াতে হচ্ছে না তা অনেকটা পরিষ্কার।