মণিপুর রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা, ভারত ভাঙ্গনের নতুন সুর
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০১৯, ১০:১২ PM , আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৪১ PM
ভারত ভাঙ্গনের নতুন সুর বেজে উঠেছে। চলতি বছরের ৫ আগস্ট ভারতের সংবিধানের কাশ্মীরীদের দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংসদে বিলুপ্ত করে দেওয়ার পর শুরু হয়েছে এ ভাঙ্গনের নতুন সুর। সেই সময় ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম কাশ্মীরের মর্যাদা বাতিলের মাধ্যমে মূলত ভারতের ভাঙন শুরু হয়ে গেলো বলে মন্তব্য করেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন।
তিনি আরো বলেছিলেন সাংবিধানিক ৫ আগস্ট কালো দিন। এটা যদি জম্মু-কাশ্মীরের সঙ্গে করা হয়, তাহলে দেশের অন্য রাজ্যগুলোর প্রত্যেকটার সঙ্গেই করা যেতে পারে। তার বক্তব্যের সত্যতা মিলে ১৫ আগস্ট ভারতের মণিপুর রাজ্যের কয়েক হাজার নাগরিকের স্বাধীনতার দাবিতে রাজপথে নেমে আসা এবং স্বাধীন নাগা রাজ্যের পতাকা প্রদর্শন করার মধ্য দিয়ে।
এরপর গত পরশু লন্ডনে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন মনিপুর রাজ্যের দুই বিদ্রোহী নেতা লন্ডনে বসবাসরত ইয়ামবিন বিরেন ও নরেংবাম সমরজিৎ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তারা প্রবাসী মণিপুর সরকার’ গঠনের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি তারা প্রবাসী সরকার গঠনের ঘোষণাও দেন।
লন্ডনে ‘প্রবাসী মনিপুর সরকারের’ নাম দেওয়া হয়েছে ‘মনিপুর স্টেট কাউন্সিল’। ইয়ামবিন বিরেনকে এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এবং নরেংবাম সমরজিতকে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করা হয়েছে। ওই দুই নেতা দাবি করেন, তাদের এ ঘোষণা রাজা লেইশেম্বা সানাজাওবার পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। লন্ডনে সাংবাদিকদের তারা জানিয়েছেন, তারা এখন আইনগত বৈধ প্রবাসী সরকার পরিচালনা করবে। আজ থেকে এই সরকারের কাজ চলবে।
এর আগে ২০১২ সালে মনিপুরে প্রথম প্রকাশ করা স্বাধীনতার ঘোষণা জোরে জোরে পড়ে শোনানো হয়। এরপর অখন্ড ভারতকে নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে।
এমনিতে ভারত বহু জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম ও ভাষার দেশ। যেদেশটি কে বলা হয় বৈচিত্র্যর মধ্যে ঐক্য। বর্তমান ভারত ২৮টি রাজ্য ও ৯টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলনিয়ে গঠিত। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজ্যসংঘ। সেভেন সিস্টার্স বা সাত বোন রাজ্য বা সাত ভগিনী রাজ্য হচ্ছে উত্তরপূর্ব ভারতের পাশাপাশি লাগোয়া অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা রাজ্য।
ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া এক টিভি টকশোতে সর্বপ্রথম রাজ্যগুলোকে একত্রে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে উল্লেখ করেন। এরপর এ নাম রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়। এদিকে সিকিমকে বলা হয় একমাত্র ভাই। ১৯৭২ সালে এই সাত রাজ্যকে সেভেন সিস্টার্সের মর্যাদা দেওয়া হয়। আসামের মাধ্যমে রাজ্যগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।যদিও আগে এসব রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। স্থানীয় আদিবাসী রাজারা দীর্ঘদিন এসব অঞ্চল শাসন করেন। গারো, খাসিয়া, ত্রিপুরা, বোরো, মিজো আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোর অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মিজোরাম, আসাম রাজ্য নিয়ে নাগা স্বাধীন ভূমি গড়ার দাবি তুলছে।
বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ দিয়ে ঘেরা সেভেন সিস্টার্স এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের সঙ্গে বাঁকানো ছোট্ট একটি অংশ দিয়ে বাকি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সশস্ত্র সংঘাত ও উত্তেজনায় বহু বছর ধরে এই সাত রাজ্যে অস্থিরতা চলছে সেখানে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। স্বায়ত্তশাসন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি জানিয়ে আসছে তারা।
এই সাতটি রাজ্যের আয়তন প্রায় ২,৫৫,৫১১ বর্গকিলোমিটার, যা ভারতের মোট আয়তনের প্রায় ৭ ভাগ। এ অঞ্চলের জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩.৭ ভাগ। সাত বোনের এক বোন হলো মণিপুর রাজ্য। মণিপুর ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল। এই রাজ্যের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম ও পূর্বদিকে মায়ানমার।
মণিপুর রাজ্যের আয়তন ২২,৩২৭ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা ২,৮৫৫,৭৯৪ জন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বার্মা মণিপুর আক্রমণ করতে পারে। এই আশংকা থেকে এখানকার দূর্বল মণিপুরী রাজা ব্রিটিশ ভারতের সাহায্য চায়। ব্রিটিশ শাসনের দেড়শ বছর পর প্রথমবারের মত ব্রিটিশরা মণিপুর ‘দখল’ করে নেয় ত্রিশকে।
মজার বিষয় হলো, পোলো খেলাটি ইউরোপীয়রা এই মণিপুর রাজ্য থেকেই গ্রহণ করে। মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে এ ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভূক্ত হলেও স্বায়ত্বশাসিত ছিল। মণিপুর স্বাধীন রাজ্য সিকিমের মতো স্বাধীন হিসেবেই ছিল। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময় মণিপুর ছিল প্রিন্সলি স্টেট বা রাজা শাসিত স্বতন্ত্র অঞ্চল। এর দুই বছরের মাথায় মণিপুর ভারতের নিয়ন্ত্রণে আসে।
কেননা ১৯৪৯ সালে মণিপুরের রাজা বুধচন্দ্র ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করেন। ভারতে মণিপুরের যোগদানের পর থেকে মনিপুরীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে আসছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, গত কয়েক দশকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও স্বাধীনতাকামীদের লড়াইয়ে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। কারাবন্দি করা হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে। এছাড়া স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী।মণিপুরে সহিংসতা একটা নৈমিত্তিক কাজেরই অংশ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলটিতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জোরালো উপস্থিতি রয়েছে।
মণিপুরের নেতারা বলেন, মনিপুরে গত ১০ বছরে অন্যায়ভাবে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া আরও দেড় হাজারের বেশি মানুষকে অবৈধভাবে বন্দী করা হয়েছে। মণিপুরে সৈন্য বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৫৮ (Armed Forces (Special Powers) Act, 1958 (AFSPA)) বাতিল করার জন্য অনশন করেছেন ইরম শর্মিলা চানু।
তার মতে, মণিপুর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে এটিই হিংসার মূল কারণ। ইরম শর্মিলা চানু একজন মানবাধিকারকর্মী। তাকে মণিপুরের লৌহমানবীও বলা হয়। শর্মিলা ২০০০ সালের ২ নভেম্বরের পর থেকে এ আইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে অনশন করেন। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর ইম্ফলের কাছেই একটি গ্রামে গুলি চালায় আসাম রাইফেলস। মহিলা ও শিশুসহ ১০ সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। তাতে গোটা মণিপুর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে। শর্মিলা এর প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন।
অনশন শুরু করার তিনদিন পরে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০ ধারায় আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে শর্মিলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিসি হেফাজতে প্রেরণ করা হয়। তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে জোর করে নাকের মাধ্যমে খাবার গ্রহণে বাধ্য করা হয়। তার পর প্রায়ই ইরম শর্মিলাকে নিয়মিতভাবে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০৯ ধারার অধীনে আটক করা হয়।
তিনি বিশ্বের দীর্ঘতম অনশন প্রতিবাদকারী। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তীব্রভাবে এই আইনটির নিন্দা করে আসছে। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সেভেন সিস্টার্সের এই রাজ্য গুলোর জন্য দেওয়া ৩৭১ ধারা বাতিল করা হয় কিনা? তা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রয়েছে তীব্র উত্তেজনা। মণিপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা ভারতকে নতুন করে সমস্যায় ফেলবে। যদিও ভারত এখনো ৩৭১ ধারা বাতিলের পক্ষে নয়।