৩০ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৪০

সাকিবের নিষেধাজ্ঞা একজন জীবন্ত কিংবদন্তির প্রতি অবিচার

সাকিব আল হাসান ও মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

বর্তমানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। যে খেলা বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিচিতি এনে দিয়েছে। এই খেলায় বাংলাদেশের অন্যতম কীর্তি খেলোয়াড়, জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য সাকিব আল হাসান।

বাংলাদেশের হয়ে খেলা সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে বিবেচিত সাকিব বিশ্বের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার বলে গণ্য করা হয়। ১০ বছর ধরে শীর্ষ অল-রাউন্ডারের রেকর্ডের অধিকারী সাকিব এখনো একদিনের আন্তর্জাতিক ও টেস্ট ফরম্যাটে সর্বোচ্চ র‍্যাংকিং ধরে রেখেছেন। তাকে নিয়ে দুকলম লিখতে গিয়ে আজ হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

অপরাধ না করেও অপরাধীর ষড়যন্ত্র ফাঁস না করায় আইনের মারপ্যাচের কবলে বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি সাকিব আল হাসান।

আমাদের পারমাণবিক বোমা নেই, অত্যাধুনিক অস্ত্র নেই। আমাদের আছে সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আমাদের অহংকার সাকিব জুয়াড়ির ফাঁদে পা না দিয়েও দোষী। শুধু বিষয়টি গোপন করার কারণে। সাকিব আইসিসি আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে এটি এখন ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

এতোদিন আমরা জানতাম অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে উভয়ে সমান অপরাধী। সাকিবের অন্যায় সে অনৈতিকভাবে জুয়ারির দীপক আগারওয়াল নামের এক জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছেন। তার প্রস্তাবে তিনি রাজি হননি। তিনি জুয়াড়ির চাওয়া অনুযায়ী দলের ভেতরের কোনো তথ্যও দেননি। ম্যাচও পাতাননি। তবুও তাঁর অপরাধ, কেন বিষয়টি আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে (আকসু) তিনি জানাননি। যেহেতু আইন তা তো মেনেই নিতে হবে।

শুধু কি সাকিব প্রথম এ ধরনের শাস্তি পাচ্ছেন? তা না। এর আগে অনেক ক্রিকেটার এ ধরনের বিষয় গোপন করার কারণে শাস্তি ভোগ করেছেন। এখনো অনেকে করছেন। শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া, কুশল লোকুরাচ্চি, দক্ষিণ আফ্রিকার জিন সাইমস, ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পরিচিত মুখ সিদ্ধার্থ ত্রিবেদী। থামি সোলেকিলে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার ১৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন। পাকিস্তানে কামরান আকমলও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞায়।

সাকিব নিজ থেকে জানাননি জুয়াড়ির কথা। এটি তার অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে। তিনি অনুতপ্ত বলে তার শাস্তি কম হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি দুর্নীতি দমন বিভাগের ৬.২ ধারা অনুযায়ী ২.৪.৪ ধারায় সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সাকিব আল হাসানকে দুই বছর (এর মাঝে স্থগিত শাস্তি এক বছর) শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

সাকিবের ভারত সফরের পূর্বে হঠাৎ করে দুই বছরের জন্য তার নিষিদ্ধ হবার ঘটনা নিয়ে চারিদিকে বিস্তর সমালোচনা চলছে। এসব সমালোচনার পেছনে কারণ গুলো হলো, প্রথমত: ভারত সফরের আগে সাকিবকে নিষিদ্ধ মানে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া। যাতে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ভালো পারফরমেন্স করতে না পারে। দ্বিতীয়ত: ক্রিকেটারদের আন্দোলনে সাকিবদের উপস্থিতি বিসিবি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। তৃতীয়ত: সাকিবের গত ইলেকশনে এমপি প্রার্থী না হবার সিদ্ধান্ত। চতুর্থত: ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ ভালো টিম যাতে না যেতে পারে। কেননা ভারতের মাটিতে ভারতকে পরাজিত করার জন্য সাকিবের খুব প্রয়োজন ছিল। পঞ্চমত: জুয়াড়ি কয়েক দফায় গত বছর সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলে জানা যাচ্ছে।

তাহলে এতোদিন পর ক্রিকেটারদের আন্দোলন ও ভারত সফরের আগে এ বিষয়টি সামনে এলো কেন? বিষয়টি আরো আগে বা পরে তো প্রকাশিত হতে পারতো।

উপরিউক্ত প্রশ্ন গুলো নতুন করে আলোচনায় আসছে। যদিও আজ হোক কিংবা কাল হোক সাকিবকে এধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো। আরেকটি বিষয় জুয়াড়ি কিন্তু ভারতের নাগরিক। সেই সময় জুয়াড়ি সাকিবকে পটাতে না পারলেও ভারত সফরের আগে সাকিব নিষিদ্ধ এটি তার জন্য কম কি? ৩ নভেম্বর টি-টুয়েন্টি দিয়ে ভারত বাংলাদেশ ম্যাচ শুরু। সাকিব তামিম নেই বলে ইতোমধ্যে এ ম্যাচের জৌলুস হারিয়েছে। সাকিবের মতো একজন খেলোয়াড়কে হারানোয় দলের জন্য এক বিরাট ধাক্কা।

টি-টুয়েন্টিতে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ জানিয়েছেন, অবশ্যই সাকিবকে মিস করব। সে বাংলাদেশ দলের অনেক বড় এক অংশ। সবাই ওর জন্য ব্যথিত। জানি সে আমাদের দলের জন্য, দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে একটা ভুল করেছে, অপরাধ করেনি। ওর প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। তাকে আগের মতোই ভালোবাসবো।

সাকিব আল হাসানের এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর। তার পরের এক বছর স্থগিত দণ্ড। ফলে ২০২০ সালেই তিনি খেলায় ফিরতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে তিনি খেলতে পারবেন না মোট ১৩টি টেস্ট ম্যাচ, ৩টি ওয়ানডে ম্যাচ ও ২০টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ। অর্থাৎ মোট ৩৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ।

আসন্ন ভারত সিরিজে সাকিব আল হাসান ৩টি টি-টুয়েন্টি ম্যাচ ও ২টি টেস্ট ম্যাচ মিস করবেন। ২০২০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে খেলবে বাংলাদেশ। ২৩ অক্টোবরের মধ্যে শেষ হওয়া সে পর্ব পেরোতে পারলেই সুপার টুয়েলভে জায়গা পাবে বাংলাদেশ। সাকিবকে ছাড়াই তাই প্রথম পর্ব পার করতে হবে বাংলাদেশকে। এমনকি সুপার টুয়েলভের দুটি ম্যাচও খেলা হবে না সাকিবের।

এর মাঝেই ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সঙ্গে সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সাকিব ক্রিকেট অঙ্গনে ফিরে আসবে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর। তবে স্থগিত নিষেধাজ্ঞার কথা ভুললে চলবে না। আগামী এক বছর সাকিবের ওপর কড়া নজরদারি করবে আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগ। কিছু ব্যত্যয় হলেই নিষেধাজ্ঞা এক থেকে দুই বছর হয়ে যাবে। সাকিবের বিরুদ্ধে এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞা যেন বাস্তবে রূপ না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সাকিবকে।

স্থগিত এক বছরের নিষেধাজ্ঞা যাতে কার্যকর না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হলে সাকিবকে নিম্নোক্ত দুটো শর্ত পূরণ করতে হবে। ক. নিষেধাজ্ঞার সময় আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের আইন বা কোনো দেশেরই দুর্নীতি বিরোধী আইন ভাঙা যাবে না।
খ. আইসিসি যেভাবে বলে দেবে ঠিক সেভাবে বিভিন্ন দুর্নীতি বিরোধী শিক্ষাকার্যক্রম ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায় ও পরিপূর্ণভাবে অংশ নিতে হবে। এ দুটি শর্ত পূরণ হলেই এক বছরেই শেষ হবে সাকিবের নিষেধাজ্ঞা।

সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর দিকটাকে আপনি বলতে পারেন মরুর দেশে এক পসলা বৃষ্টির মতো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জিততে পারার, বিশ্বসেরা হবার বিশ্বাস অর্জনকারী এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পথ চলা শুরু হয় ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক দিয়ে। তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে আইসিসির খেলোয়াড়দের র‍্যাংকিং অনুসারে টেস্ট, ওডিআই ও টি-২০ প্রত্যেক ক্রিকেট সংস্করণে প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এক নম্বর অল-রাউন্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

তিনি প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে একদিনের ক্রিকেটে ৪,০০০ করার গৌরব অর্জন করেন এবং ২০১৭ সালের ১৩ই জানুয়ারি টেস্টে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ২১৭ রান সংগ্রাহক হন। তিনি টি-২০তে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০০ রান পূর্ণ করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০৬ ম্যাচে ২৬০ উইকেট ও ক্রিকেটের সবচাইতে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ টি-টুয়েন্টিতে তিনি শিকার করেছেন ৭৬ ম্যাচে ৯২ উইকেট। ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তিনি তার ক্যারিয়ারের মাত্র ১২ থেকে ১৩ বছরেই ৫৬০ টিরও বেশি উইকেট শিকার করে ফেলেছেন।

সাকিবকে একবার টিভি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, প্লেয়ারদের ভালো খেলার পেছনে একটা অনুপ্রেরণা থাকে। আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কী? জবাবে সাকিব তার চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। সাকিবের মুখে ঘটনাটি এমন ছিল, আমি একবার ঢাকার জ্যামে বসে খুব ঘামছি। এমন সময় এক পথশিশু আমার গাড়ির কাছে এসে বললো- স্যার, একটা ফুল নিবেন? আমি তার সাথে থাকা সবগুলো ফুল নিয়ে নিলাম। তারপর গাড়ির জানালার কাচ খুলে দাম দিতে যাবো- ঠিক এমন সময় ওই ছেলে আমাকে ঠিকমতো চিনে ফেললো!

ফুলওয়ালা ছেলেটা বললো- আপনে ছক্কা সাকিব না? হাসতে হাসতে বললাম- হ্যাঁ তখন ছেলেটা দাম নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলল, দাম লাগবো না, স্যার! আপনে প্রত্যেক ম্যাচে কমসে কম একটা করে ছক্কা মাইরেন- তাইলেই হইবো! প্রতিবার মাঠে নামার আগে আমার মাথায় থাকে- ‘ওই ছেলের কাছ থেকে নেওয়া ফুলের দাম’।

এই হলেন আমাদের সাকিব আল হাসান। শুধু কি তাই ফিক্সিংয়ের অপরাধে ৫ বছর নিষিদ্ধ হয়ে থাকা মোহাম্মদ আশরাফুলকে যে কজন ক্রিকেটার কখনোই আর বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে দেখতে চাননি, সাকিব তাঁদের একজন। ম্যাচ পাতানো বা দুর্নীতিকে তিনি এতটাই ঘৃণা করেন।

এ কারণেই হয়তো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন সাকিব। সেই সাকিব আজ অপরাধ না করেও অপরাধীর কাঠগড়ায়। দীর্ঘ এক বছর ক্রিকেটের মাঠে তার পদচারণা, উল্লাসের বাধ ভাঙ্গা স্ফুরণ থাকবে অনুপস্থিত। ভাবতেই বুকের কোণে কষ্ট অনুভূত হবে ক্রিকেট প্রেমী ভক্ত অনুরক্তদের।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক