পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিন্ডারগার্টেন নয়
যারা দলীয় ছাত্ররাজনীতি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা সম্ভবত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এরকম একটা কিছু বোঝেন যার সাথে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সাথে পার্থক্য করা মুশকিল। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করবেন আর বড়জোর কিছু এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটি করবেন, তাও শিক্ষক/প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে ও অনুমতি নিয়ে।
-এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, বুলেটিন, ম্যাগাজিন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। যেকোনো প্রকাশনার প্রতিটি সংখ্যার খসড়া প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বের হবে। প্রকাশিত কোন বক্তব্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের পরিপন্থী বলে উপাচার্য মনে করেন, তাহলে তিনি তা বাতিল করতে পারবেন। কোন ধর্মঘট করা যাবে না।
-বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট থাকবে, শিক্ষার্থীদেরকে বাড়তি খরচ করে মেসে থাকতে হবে। তার উপর বছর বছর পরিবহন ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, চিকিৎসা ফি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ফি ইত্যাদি ফি বাড়তে থাকবে। গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত গ্রন্থ থাকবে না, গ্রন্থাগার সন্ধা ৭টার সময়ই বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছুতে প্রাসাশনিক শিক্ষকদের হস্তক্ষেপ ও খবরদারি সহ্য করতে হবে শিক্ষার্থীদেরকে।
-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশাসনিক পদের বিন্যাস, পদোন্নতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও বদলির মতো বিষয়গুলো ঘটবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগে উপাচার্য স্বজনপ্রীতি করবেন, ভবন নির্মাণে দুর্নীতি করবেন কিন্তু কোন সংগঠিত প্রতিবাদ হবে না।
না, এগুলো কোন কাল্পনিক বক্তব্য নয়। ঠিক এই ঘটনাগুলোই ঘটছে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত বলে বহুল প্রশংসিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে সংবাদপত্রটি ছাত্ররাজনীতি বন্ধের এজেন্ডা নিয়েছে সেই সংবাদপত্রেই এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিস্তারিত দেখুন: ‘রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সবকিছুই রাজনীতিকেন্দ্রিক’, প্রথম আলো, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ; ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়: আবাসন-সংকটের সঙ্গে বাড়তি ফির চাপ’, প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮।
অনেকে বলেন দলীয় ছাত্ররাজনীতি না থাকলেও ছাত্রদের নির্দলীয় ভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করতে তো কোন সমস্যা নাই, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে তারা তাদের পক্ষে উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন। এই মানুষদের কাছে আমার প্রশ্ন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা কোটা আন্দোলনে কম বেশি অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকট, গ্রন্থাগার সংকট, বছর বছর ফি বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ, মত প্রকাশে বাধা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন নি?
এখানেই সাংগঠনিক ভাবে রীতিমত অনুশীলনের মতো করে রাজনৈতিক আদর্শের বোঝাপড়া ও চর্চা করার গুরুত্বটা চলে আসে। শিক্ষা অর্জনের জন্য যেমন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের প্রয়োজন হয়, রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও প্রয়োগের জন্যও তেমনি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন হয়। নিয়মিত পাঠচক্র, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি শুধু সমস্যা/সংকট সনাক্ত করাই নয়, সেই সংকট মোকাবিলা করে দাবী আদায়ের জন্য ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অবিচল থেকে ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই করার শিক্ষাটাও রাজনৈতিক সংগঠন থেকেই আসে। বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন অবশ্যই, কিন্তু লড়াই সংগ্রাম গড়ে তোলা ও সফল করার জন্য প্রচার, প্রচারণা করা, মানুষকে সংগঠিত করা, কর্মসূচী তৈরি ও পালন করা, ক্ষমতাসীনদের হামলা মামলা মোকাবিলা করা ইত্যাদির জন্য সংগঠিত রাজনৈতিক তৎপরতার কোন বিকল্প নেই।
শুধু ছাত্রছাত্রীই নয়, সমস্ত শ্রেণী পেশার মানুষদের জন্যই সাংগঠনিক রাজনীতি চর্চা জরুরি, শুধু নিজ শ্রেণী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই না, গোটা দেশের ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্যও। স্বত:স্ফূর্ত বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে অনেক সময় জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে উঠলেও, রাষ্ট্রের/প্রতিষ্ঠানের কোন নীতি বা পদক্ষেপটা নিজ শ্রেণী/গোষ্ঠীর স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে, কোনটা কায়েমী স্বার্থের পক্ষে যাচ্ছে তার বোঝাপড়া কিংবা মোকাবিলা করা, প্রতিকূলতার মধ্যেও দীর্ঘ লড়াইয়ে নিয়োজিত থাকার মতো কাজ সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সাংগঠিনক চর্চা ছাড়া হয় না। প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি আছে সেগুলোর অবস্থা কি খুলনার থেকে ভাল? না, কিন্তু তার কারণ হলো ছাত্ররাজনীতির যে ধারাটি শিক্ষার্থীদের অধিকার ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় লড়াই সংগ্রাম করে সেই ধারাটির শক্তিশালী না হওয়া। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই না, সমাজের সকল স্তরে ও প্রতিষ্ঠানে ছাত্র শিক্ষক শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে লড়াই করে এরকম রাজনৈতিক সংগঠনকে শক্তিশালী করা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের অন্য কোন উপায় নেই।
লেখক: প্রকৌশলী ও সাবেক ছাত্রনেতা।