কোপাকুপি বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মকাহিনী
শামসু ছোটবেলা থেকে খুবই চঞ্চল ও অস্থির প্রকৃতির। ডানপিটে স্বভাবের আরকি। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত রোল নাম্বর ছিল এক। ফাইভ ও এইটে তো বৃত্তি আছেই। প্রচন্ড মেধাবী ছেলে শামসু। এলাকায় ভদ্র ছেলে হিসেবে যথেষ্ট তার নাম ডাক আছে। যশ সুনামে একদিন সে তার বাবার নাম জেলে কাইলা কবিরকে ছাড়িয়ে যায়। সবাই শামসুকে এক নামে চিনে।
গ্রামে কুপির আলো কখনো হারিকেনের মিটমিট আলোয় পড়াশোনা করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সে গোল্ডেন এ প্লাস পায়।তাদের সংসার ছিল দারিদ্র্যতার আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। বাবা কাইলা কবির আগে মাছ ধরতো এখন জেলেগিরি বাদ দিয়ে ভবঘুরে। সংসার সাধনা বাদ দিয়ে বৈরাগ্য জীবন বেছে নিয়েছে। শামসু ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে কিন্তু অদম্য স্পৃহা ও ইচ্ছাশক্তি শামসুকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলে। তার জীবনের ভবিষ্যৎ ইচ্ছা ডাক্তার হওয়া। গ্রামে খেলাধুলা, সামাজিক সব কাজে শামসু এগিয়ে। দুচারটে টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালিয়ে নেয় সে।
কাইলা কবির শেষ পর্যন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একখানা বিয়ে করেছিল পার্শবর্তী গ্রামের ছুরতন বেওয়াকে। কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে শামসুর কোনো অবস্থানই ছিল না। সৎ মায়ের ঘ্যানঘ্যানি হইচই ঘনঘন গায়ে পড়ে ঝগড়া শামসুর জীবনটাকে একখন্ড নরক বানিয়েছিল। কথায় বলে না যে সহে সে রহে। শামসু তেমনি একজন সর্বংসহা ছেলে।
গ্রামের কেরামত স্যার ছিলেন খুবই সজ্জন ও বিদ্বান মানুষ। বড্ড পরোপকারী, হিতৈষীও বটে। শামসুর এসএসসির ভালো রেজাল্ট করলে কেরামত স্যার শামসুকে তার প্রাইভেট ব্যাচে ফ্রি পড়ার সুযোগ দেয়। ফলে শামসুর জন্য ভালো রেজাল্ট করা সহজ হয়ে যায়, তেমন কঠিন কিছু ছিল না। গ্রামের সবাই শামসুর মেধায় খুব খুশী ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেরামত স্যারের কাছে পড়ার সময় শামসুর এলাকার মাতবর ইকরাম সাহেবের মেয়ে জুলেখার সঙ্গে পরিচয় ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে। গোপনে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন চলে ভাব ভালোবাসার বিনিময়। শামসু জুলেখাকে কয়েকটি চিঠি দিয়েছিল। যে চিঠিগুলো জুলেখা তার বালিশের কভারের ভেতরে রেখেছিল।
একদিন জুলেখার মা সুলেখা খাতুন বালিশের কভার খুলতে গিয়ে চিঠিগুলো তার হস্তগত হয়। এরপর চাল চুলাহীন একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক অবগত হয়ে ইকরাম সাহেব মেয়েকে দীর্ঘদিন চার দেয়ালে বন্দি করে রাখে। এতে জুলেখার শামসুর প্রতি ভালোবাসা আরো তীব্র হতে থাকে। তাদের দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হলেও তাদের হৃদয়ের অনুভব ছিল অবিরাম ও নিরবিচ্ছিন্ন। ইতোমধ্যে এইচএসসির রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। শামসু গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পাস করে। গ্রামবাসি সকলে চান্দা তুলে শামসুকে শহরে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি করে দেয়।
শামসু শহরের মেসে থেকে ডাক্তার হবার স্বপ্নে ছিলে বিভোর।সে ডাক্তারী পাস করে গ্রামের মানুষের সেবা করবে। জুলেখাকে নিয়ে সুন্দর সুখের একটি সংসার সাজাবে। বইয়ের পাতা খুলতেই ভেসে উঠে জুলেখার সেই মায়াবী মুখাবয়ব। নেই মোবাইল, চিঠি দেওয়ার পথটা তো আগেই রুদ্ধ। জুলেখা কেমন আছে, আমাকে ভুলে গেছে কিনা নানা সাত পাঁচ চিন্তায় শামসু ব্যাকুল। এসব ভাবতেই ভেতরটা কষ্টে তার মোচড় দিয়ে উঠে ।
এরমধ্যে যথারীতি এডিমিশন টেস্ট হয়ে যায়। মেডিকেলে দশমিক পাঁচ পয়েন্টের জন্য শামসুর চান্স হয় না। অগত্যে শামসু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন টেস্ট দেয়।এডমিশন টেস্ট দিয়ে শামসু বাংলাদেশ কোপাকুপি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপাতি হকিস্টিক এন্ড কালচার বিভাগে ভর্তি হয়। বর্তমানে এই সাবজেক্ট টপ লেভেলের। স্টুডেন্ট লাইফে ফুল টাইম ও চাকরি জীবনে পেশা হিসেবে এ সাবজেক্টের রয়েছে যথেষ্ট মার্কেট ভ্যালু।
সাবজেক্টের কদরের দিক বিবেচনায় শামসু এই সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে যায়।তার পড়াশোনা ঠিকমতো চলছে কিন্তু মেসে থেকে তার পড়াশোনার খরচ নির্বাহ করা দিনদিন দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। শামসু হলে উঠতে চায়, কিন্তু হলে উঠতে গেলে তো রাজনীতি করতে হবে। সে রাজনীতিকে মনে প্রাণে প্রচন্ড ঘৃণা করে। পত্রিকায় প্রতিনিয়ত খুনখারাপি ও মারামারির সংবাদ পড়ে শামসু প্রচন্ড বিরক্ত । এদিকে হাতে তেমন টাকা পয়সা নেই। কষ্টের পড়াশোনা কি এখানেই বন্ধ হবে?নানাবিধ চিন্তায় অস্থির শামসু। হলে উঠতে পারলে দুই একটা টিউশন করলে তার পড়াশোনায় কোনো ছেদ ঘটবে না। একদিন ডিপার্টমেন্টের রাজনীতি করা বড় ভাই লাভলুর হাত ধরে বাসুদ রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে শামসু রামদা স্মৃতি হলের ৩০১ নং রুমে উঠে।রুমটি অবশ্য হলে পিস্তল রুম নামে পরিচিত।
এখানে বাসুদ দল মানে বাংলাদেশ সুবিধাবাদী দল।এই দলের মাধ্যমে হলে উঠতে হলে শর্ত ছিল, নিয়মিত গেস্টরুম, মিছিল মিটিং, বড় ভাইদের সালাম ইত্যাদি করা। শামসু তাতেই রাজি কেননা এছাড়া তার বিকল্প কোনো উপায় নেই। এদিকে বাবার সাথে কদাচিৎ যোগাযোগ হয় শামসুর, জুলেখার খবর তেমন একটা জানে না। তবে কয়েকদিন আগে অবশ্য জুলেখা একটি পত্র দিয়েছে। তাতে লিখছে সে শামসুর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করবে। এরমধ্যে নিয়মিত রাজনীতিতে সরব হয়ে উঠে শামসু। কিছুদিন আগে লাভলুর নির্দেশে শামসু এক সিনিয়র বড় ভাইয়ের কান ফেটে দেয়। এখনো সেই কানে ঠিকমতো শুনতে পায় না সেই সিনিয়র। নেতার নির্দেশে ফেসবুকে দলবিরোধী কথা লেখায় একজন জুনিয়রকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে শামসু। পরের দিন পত্রিকায় আসে "কুপা শামসুর কারণে অনিরাপদ শিক্ষার্থীরা"।
এরপর থেকে শামসু ক্যাম্পাসে কুপা শামসু নামে পরিচিত হয়ে উঠে।হলের ডাইনিং, ক্যানটিনে ফাও খাওয়া, কথায় কথায় জুনিয়র, সিনিয়রদের মারধর যেন তার মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়। সিগারেট, বিয়ার বিভিন্ন নেশায় আসক্ত শামসু এখন বেপরোয়া। হলের অনেকেই তার দ্বারা নির্যাতন নিগ্রহের শিকার। একদিন হঠাৎ মিথুন নামের একটি ছেলের লাশ হল থেকে উদ্ধার করা হয়।সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ সেদিন উদ্ধার করে কোনো লাভ হয়নি। কেননা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র বিদ্যুৎ কিছুক্ষণের জন্য বিচ্ছিন্ন করে খুনটা করেছিল। ভিডিও ফুটেজ না পেলেও ময়না তদন্তের রিপোর্টে শ্বাসরোধ করে হত্যার প্রমাণ মিলে। তবে ভিকটিমের চোহারায় জখমের চিহ্নের ফিঙ্গার প্রিন্ট দেখে খুনিদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এই খুনের মূলহোতা ছিল শামসু ও আরো দশ বারোজন।মামলার এজাহারভুক্ত সবাই গ্রেপ্তার হলেও শামসু ছিল লাপাত্তা। কিছুদিন পর ক্যাম্পাসেের পাশে ঢাকনা খোলা ম্যানহোলের পাশ থেকে শামসুর লাশ উদ্ধার করা হয়। অত্যধিক মদপানের দরুণ মাতাল অবস্থায় রাস্তায় কোনকিছুর সঙ্গে ধাক্কায় শামসু অক্কা পেয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এদিকে দীর্ঘ নয় মাস মিথুন হত্যার মামলা চলে। কিন্তু পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে খুনিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।মামলা চলাকালে মিথুনের পক্ষের কোন সাক্ষী ভয়ে আদালতে উপস্থিত হতে পারেনি।এদিকে প্রতিষ্ঠার পর এই পর্যন্ত কোপাকুপি বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ জন শিক্ষার্থী নিহত হলেও কেউ সুবিচার পায়নি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই তো কোপাকুপি বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং এখানে চলবে কোপাকুপি কিন্তু বিচার হবে না।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক