সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক
গত বৃহস্পতিবার চাঞ্চল্যকর সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যার রায় ঘোষণা হয়েছে। রায়ে মামলার একমাত্র আসামি ওবায়দুল হককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ রায় যেমন স্বস্তির, তেমনি অপরাধীদের প্রতি রাষ্ট্রের কঠোর বার্তাও বটে। অপরাধ করে পার পাওয়া যায় বলে যে ধারণা অপরাধীদের মনে বদ্ধমূল রয়েছে, এই রায় তাতে কুঠারাঘাত করেছে। এখন দেখার বিষয় রায় কত দ্রুত কার্যকর হয়।
আমাদের দেশে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘ সময় কাঠখড় পোড়াতে হয়। এরপরও অধিকাংশ সময়ই সুবিচার মেলে না। সমাজের সর্বত্রই বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দানা বেঁধেছে, তা অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু রিশা হত্যা মামলার যে রায় আদালত দিয়েছেন, তা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়- এই ধারণাটি অন্তত হ্রাস পাবে। একটি রায় শুধু অপরাধীকেই শাস্তি দেয় না, বরং তার আশপাশে যারা থাকে বা যারা এ ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত, তাদেরকেও সতর্ক করে দেয়। এতে একজনের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে অন্যরা সংশোধনের সুযোগ পায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, 'এ ধরনের ঘটনা ন্যক্কারজনক; ভয়ঙ্কর অন্যায়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, সে জন্য আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো।'
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে গণমাধ্যম বেশ সরব ছিল। সর্বমহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। এরপরও মামলাটির প্রাথমিক রায় পেতে সময় লাগল তিন বছর। একটি বিষয় বরাবরই লক্ষ্য করছি, কোনো অপরাধের ঘটনা গণমাধ্যমে এলেই কেবল তা নিয়ে নড়েচড়ে বসে সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলো। গণমাধ্যমে না এলে তা নিয়ে কেউ কথা বলতে চান না। ফলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অপরাধের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তার বেশিরভাগই বিচারের আওতায় আসছে না। এছাড়া অপরাধ ও অপরাধীকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতাও সমাজে বিদ্যমান। কোনো কিছু ঘটলেই তাতে রাজনৈতিক উপাদান মেশানোর একটি প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করি, যা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। আবার অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ গ্রহণ করতে চায় না পুলিশ। ভুক্তভোগী যদি অভিযোগই করতে না পারেন, তাহলে বিচার পাবেন কীভাবে? কোনোভাবে অভিযোগ লেখানো গেলেও আসামি গ্রেফতারে শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া আদালতের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকেই ন্যায়বিচারের মুখ দেখেন না। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। পুলিশ প্রশাসনে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়ানো প্রয়োজন। দরকার হলে নতুন আইন করা হোক। বিচারক নিয়োগ দিয়ে মামলাজট কমানোর পাশাপাশি এ ধরনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এতে আইন ও বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকলে অপরাধপ্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে আমাদের ব্যাপক আকারে সামাজিক সচেতনতা দরকার। বর্তমানে যেসব অপরাধ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সেগুলো আমাদের সমাজের মধ্যেই সংঘটিত হচ্ছে। আপনার সন্তানরা কখন কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, তা খেয়াল রাখা দরকার। ছেলেমেয়েদের মতামতের মূল্যায়ন করতে হবে। যাতে তারা যে কোনো সমস্যার কথা পরিবারকে অবগত করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধকর্ম মেনে নেওয়ার যে প্রবণতা সমাজে লক্ষ্য করা যায়, তাও ঐক্যবদ্ধভাবে পরিহার করা দরকার।
সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার পর গোটা দেশ ফুঁসে উঠেছে। ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুতই দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। মামলার অধিকাংশ আসামি গ্রেফতার হয়েছে। ঠিক একই সময়ে স্কুলছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যার রায় আমাদের আশ্বস্ত করেছে। আমরা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করছি। এই ধারা অব্যাহত রেখে সব ধরনের অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে আমাদের হয়তো তনু, নুসরাত, রিশা কিংবা আবরারের মতো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হবে না।
লেখক: সাংবাদিক