ঢাবির হলে হলে ছাত্রলীগের টর্চার রুম
বুয়েটে টর্চার রুমে বেধড়ক পিটিয়ে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় সামনে চলে আসছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনার কথাও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কথাও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় নানা ধরনের নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ধরনের রুমগুলোকে গেস্ট রুম ও পলিটিক্যাল রুম বলা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে এগুলো টর্চার রুম হিসেবে পরিচিত। ভিন্ন মত প্রকাশ করলে ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ না নিলে রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় এই রুমগুলোতে। এ ধরনের নির্যাতনের কথা প্রশাসন জানলেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেও জানান শিক্ষার্থীরা।
ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রনির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এখানকার আবাসিক হলের অতিথিদের জন্য বরাদ্দ কক্ষ ‘গেস্ট রুম’। সারা দিন শিক্ষার্থী-অতিথিরা এই কক্ষে বসে বিশ্রাম নিলেও রাত ১০টার পর বদলে যায় চিত্র। এখন ছাত্রলীগের হল নেতারা নিয়ম শেখানোর নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন। সেখানে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলে অথবা বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করলে এর বিচার করা হয়। এ সময় অকথ্য ভাষায় গালাগাল থেকে শুরু করে ধমক ও স্টাম্প দিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ ছাড়া প্রতিটি হলে পলিটিক্যাল রুম বলে কিছু রুম থাকে। সেখানে মিনি গেস্ট রুম অথবা ডেকে নিয়ে বিভিন্নভাবে অপমান করা হয়। করা হয় নির্যাতন।
আর জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৯টি হল রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি হল ছেলেদের, ৫টি মেয়েদের এবং একটি ইন্টারন্যাশনাল হল। ছেলেদের প্রতিটি হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে মোট ৪টি গ্রুপ রয়েছে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট একাধিক দিনে ৪টি গ্রুপেই প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষকে রাতে গেস্ট রুমে আসতে হয়।
মেয়েদের হলে ছাত্রলীগের গ্রুপ থাকলেও গেস্ট রুমের মাত্রা কম। ছেলেদের ১৩টি হলের প্রতিটিতে একাধিক টর্চার রুম রয়েছে বলে জানা গেছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এই টর্চার রুম নিয়ন্ত্রণ করেন।
কেন এমন হয় জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর তুলনায় হলের সিট সংকট রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সিটের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সিট বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এই সুযোগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিটের বিনিময়ে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতে বাধ্য হন। রাজনৈতিক প্রোগ্রামে না গেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজয় একাত্তর হলের এক ছাত্রকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে গেস্ট রুমে পিটিয়েছেন হল ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ সময় ওই ছাত্রকে হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন তারা। মারধরের শিকার ওই ছাত্র জানান, হলের ছাত্রলীগ নেতা তাকে হুমকি দেন ‘প্রোগ্রামে যাবি নাকি হল ছাড়বি।’ মারধরের শিকার ছাত্রের নাম রানা আখন্দ। তিনি সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্র। যদিও ওই ঘটনায় হল প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা নিলেও ছাত্রলীগ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ১৪ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে প্রথম বর্ষের ২৫ জন শিক্ষার্থীকে পলিটিক্যাল রুমে মারধরের অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে মনির নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের পর লুকিয়ে রাখা হয়। পরে হল প্রশাসন ও সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে রাত দুইটার দিকে অন্য একটি হল থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাস্টারদা সূর্যসেন হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি পড়ালেখা করার জন্য। কিন্তু রাতে দুই-তিন ঘণ্টা গেস্ট রুমে বড় ভাইয়েরা আটকে রাখে। প্রোগ্রাম থাকলে অনেক সময় ক্লাস বাদ দিয়ে প্রোগ্রামে যেতে হয়। প্রোগ্রামে না গেলে গেস্ট রুমে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়। আমাকে একদিন থাপ্পড় দিয়েছে প্রোগ্রামে না যাওয়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি পড়ালেখা করার জন্য, প্রোগ্রাম করার জন্য নয়। কিন্তু কার কাছে বিচার দেব। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
জানতে চাইলে কবি জসীমউদদীন হলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাসের খোঁজখবর রাখি আর না রাখি ছাত্রলীগের প্রোগ্রামের খোঁজ রাখতে হয়। প্রোগ্রামে না গেলে হল থেকে বের করে দেয়। মারধর করে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা বড় ভাইয়েরা।
গত বছর ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হওয়া মহসিন হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, রাত ১২টার দিকে আমাকে গেস্ট রুমে ডাকা হয়। সেখানে উপস্থিত হলে আমার ফেসবুক চেক করা হয়। কিছুক্ষণ পর হল ছাত্রলীগের পোস্টেড কয়েকজন আমাকে রড-স্টাম্প দিয়ে রাতভর মারধর করে। ভোররাতে পুলিশের কাছে আমাকে উঠিয়ে দেয়। আমার দোষ ছিল আমি ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে কম যাই।
এ বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ ধরনের নির্যাতনে জড়িত না। তবে যদি এ রকম কোনো অভিযোগ আসে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
জানতে চাইলে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, এ রকম টর্চার রুমের কথা আমার জানা নেই। তবে কেউ যদি অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয় না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানীবলেন, আমাকে যখন বলা হয় আমি ব্যবস্থা নিই। সামনে আরও নেব।
সূত্র: দেশ রূপান্তর