বাঙ্গালি পুরুষের যৌন হতাশা ও পাক্ষিক ধর্মপ্রীতি
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সায়ন্তন'১৬ - সহস্র প্রাণের প্রত্যয়ে, স্মৃতির উল্লাসে’ প্রোগ্রামের কালার ফেস্টের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, ভিডিওটিকে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন টাইপের কোন একটা পেইজ খুব নেগেটিভ ভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেই পেইজের কমেন্টে বক্সে বাঙ্গালির 'সেক্সিজম, ধর্মালোচনা, ইসলাম প্রচার ও আসন্ন কেয়ামতের ভবিষ্যতদ্বানী' নিয়ে যে শংকা প্রকাশ করেছেন তা দেখে প্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদের 'বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি?' লেখাটার কথা ভীষণ মনে পড়লো।
''অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটা কর্তব্য বলে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্ত রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। বাঙালি প্রতিবেশীর ঘরবাড়ির ওপর বিনিদ্র চোখ রাখে, ওই বাড়িতে কে বা কারা আসে, কখন আসে ও যায়, সব সংবাদ রাখে, এবং সংবাদ বানায়।
বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর আরেকটি দিক হচ্ছে কুৎসা রটনা। কুৎসা রটিয়ে সুখ পায়; আর এ-কুৎসা যদি যৌন হয়, তাহলে তা সর্বশ্রেষ্ঠ। বাঙালি একটি নিন্দাকেই বড়ো নিন্দা মনে করে, তা হচ্ছে লাম্পট্য নিন্দা। কোনো পুরুষকে লম্পট অথবা কোনো নারীকে ভ্রষ্টা হিসাবে চিহ্নিত করে দিতে পারলে বাঙালি জীবন সার্থক হয়েছে বলে মনে করে।
অধিকাংশ বাঙালিই যৌন আলোচনায় সুখ পায়, অন্যের যৌনজীবন নিয়ে কুৎসা রটায়; বড়দের আলোচনার বড় অংশ যৌনতাবিষয়ক। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ভন্ড তারা; তাদের কাছে এ-সম্পর্কিত কিছু জানতে গেলে তারা এমন ভাব করে যেনো তারা যৌনতার কথা কখনো শোনে নি; কাম কী তারা জানে না।''
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে কালার ফেস্টের পর ছেলে-মেয়েরা গানের তালে তালে নাচতেছে। অশ্লীল কোনো নাচ না, উদ্দীপনামূলক কোন নাচও না। তবে ছেলেদের গায়ে টিশার্ট নেই, তারা নাচতেছে-এইটাই অপরাধ! যদিও মেয়েরা সবাই একই রঙের শাড়ি পরে আছে এবং খুব শালিনতা বজায় রেখে আনন্দ উৎসব করছে। তবুও...!
আমি আজকে অল্পের ভিতর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ প্রোগ্রামটি নিয়ে কথা বলবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে ৪টা বছর অতিবাহিত হওয়ার পর যাপিত জীবন সামলে উঠতে একটা সময় মেয়াদ ফুরিয়ে আসে। আয়োজন শেষ হয়ে আসে সব। ছেড়ে যেতে হয় প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়, ছাড়তে হয় প্রাণের হল, প্রিয় প্রাঙ্গণ। এরই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন। কোনো এক নতুন সকালে অতীত হয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের চার বছরের গল্প। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ আনন্দ অনুষ্ঠানটা র্যাগডে!
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বছর ৩ দিনব্যাপী শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান বা র্যাগডে অনুষ্ঠিত হয়। খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় কালচারাল প্রোগ্রাম বলা যায় এটাকে। প্রোগ্রামের বাজেট থাকে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকা। শিক্ষার্থীরা এই টাকা নিজেরা নিজেদের ব্যাচ থেকে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করে, তারপর টিশার্ট বিক্রি করে, স্পন্সর খোঁজার চেষ্টা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও কিছু টাকা প্রদান করে যার মাধ্যমে সংগ্রহ হয় পুরো টাকাটা।
প্রোগ্রামের ১ম দিন থাকে শহরব্যাপী ট্রাক র্যালি, ক্যাম্পাসে ফিরে কালার ফেস্ট, গানের সঙ্গে নাচ, বিকেলে ভিন্ন রকমের ইভেন্ট ও র্যাগ ব্যাচ কর্তৃক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মজার ব্যাপার হচ্ছে এর আগের দিন রাতটাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক নাইট’, সেদিন সিনিয়াররা যান জুনিয়ার বনে। জুনিয়াররা সকলে মিলে সিনিয়ারদের ‘যেমন খুশি ত্যামন সাজাবে’, সিনিয়াররা কোনো ‘না’ করতে পারবে না!
পরের দিন শহর ব্যাপী র্যালি শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে শুরু হয় রঙের খেলা। জুনিয়াররা তখনো ‘স্ট্রাইক পজিশনে’। তারা সিনিয়ারদের নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশের অংশ হিসেবে সকলের টিশার্ট ছিড়ে ফেলবে। এবং খুব সাবধানতার সঙ্গে মেয়েদের সঙ্গে যেন হয়রানিমূলক কোনো ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারটা খেয়াল রাখবে। সব ছেলেরাই যেন সেদিন এক একজন রক্ষক হয়ে মেয়েদের সম্মান রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত থাকেন। এই প্রাপ্ততা দেয়া, এ সম্মান দেয়া বহুদিন ধরেই চলে আসছে এখানে। আজ অবধি কোনো মেয়ে কালার ফেস্টে ‘হয়রানি’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেনি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা ছেলে তাদের সম্মানের প্রাপ্ততা বজায় রাখার ব্যাপারটা নিশ্চয়তা দিয়েছে। বহুদিন ধরে।
২য় দিন চলে ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো থেকে সমন্বিতভাবে বিদায়ী ব্যাচকে দেয়া হয় ‘ট্রিট’। আমি নিশ্চিত ও চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি এতো চমৎকার ও মৌলিক ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়না।
৩য় দিনটা অন্যরকম। পুরো খুলনা শহর এসে ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে। গ্র্যান্ড কনসার্ট। দেশসেরা ৩-৪টা ব্যান্ডদল পারফর্ম করে এখানে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে কানাচে সিসি ক্যামেরা ফিট করা হয়। পুরো ক্যাম্পাসে প্রত্যেকটা ভবনকে, হলগুলোকে আলোক সজ্জিত করা হয়। খুলনাসহ আশেপাশের শহর থেকে মানুষ আসে এ প্রোগ্রাম দেখতে। ছাত্ররা নিজেরাই নিশ্চিত করে সকলের নিরাপত্তা। মেয়েদের জন্য আলাদা জায়গা নির্ধারন করা থাকে। সেখানে ব্যারিকেট তৈরী করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাইরের সকল মেয়েরা তাদের নির্ধারিত জায়গায় বসে নিরাপদে কনসার্ট উপভোগ করে। যেকোলো ধরনের বিশৃংখ্লা খুব কঠোরভাবে দমন করা হয়। আজ অবধি কোনো ধরনের অপ্রতিকর ঘটনা ছাড়াই প্রোগ্রামগুলো শেষ হয়েছে।
কিন্তু তবুও এসব নিয়ে সমালোচনা হবে। ধর্মকে আনা হবে। রাতজাগা 'ফেসবুক মুমীনরা' পরীমনির ছবির নিচে গিয়ে লাব্রিয়েক্ট দিয়ে 'নাউযুবিল্লাহ' বলবে, নুসরাত ফারিয়ার ক্লিভেজ বের করা ছবিতে গিয়ে 'ইসলামে পর্দার গুরুত্ব ও তাৎপর্য' নিয়ে আলোচনা করবে!
আমাদের ধর্মপ্রাণ এসব ফেসবুক মুমীনদের ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম, তারা ঘুষ খাবে টুপি পরে, কিন্তু টাকা রাখার জন্য ইসলামি ব্যাংক খুঁজবে। 'ধর্ষণ' হলে অবশ্যই সেটা মেয়ের দোষ কিন্তু ইসলামে যে ধর্ষককে পাথর ছুরে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে সে 'হাদিস' নিয়ে আলোচনা করবে না!
আমরা হলফ করে বলতে পারি, আমাদের এ প্রোগ্রামে কোনো ধরনের অপ্রতীকর ঘটনা ঘটেনা। আমরা নিজেরাই নিরাপত্তা দিই সকলের। আমাদের নিয়ে সমালোচনা করার আগে আমাদের জানুন। কেয়ামত নিয়ে শংকা প্রকাশ করার আগে নিজেকে প্রস্তুত করুন। সবাইকে কিন্তু নিজের হিসেবটা নিজেরই দিতে হবে!
আমাদের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্যে কোনো নিজস্ব ছাত্রফোরাম নেই,কোন দলীয় নেতা নেই, কোনো দলের স্বার্থনেষী কার্যক্রম নেই, নেই কোনো টেন্ডারবাজী, কোনো অস্ত্রের ঝংকার, কোনো রক্তের বিভীষিকা! তবুও এখানে টিকে আছে নেতৃত্ব, বেঁচে আছে সংগ্রাম ও প্রতিবাদ। এখানকার ছাত্ররা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর, স্বপ্ন দেখায় সুন্দর আগামীর। এরা বিচার করতে পারে নিরপেক্ষভাবে, এরা প্রতিবাদ করতে পারে স্বার্থন্বেষী ভাবনার বাইরে এসে, এক হয়ে। - আর এটাই আমাদের শক্তি!
লেখক: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমানে মাইক্রোসফটে কর্মরত।