০২ অক্টোবর ২০১৯, ১৯:৩৫

পথশিশু দিবসেও হাজার টাকার হিসেবে ব্যস্ত আরিফ

আরিফুল ইসলাম ইমন  © টিডিসি ফটো

হাতে গুনে কিছু হিসাব মেলাতে পারে আরিফুল ইসলাম ইমন। কিন্তু তার কথা অনুযায়ী দিনে ২০০ পত্রিকা বিক্রি করে সে। প্রতি পিস পত্রিকার ৪ টাকা করে ২০০ পত্রিকার দাম পড়ে ৮০০ টাকা। আর ৫ টাকা করে বিক্রি করায় তার লাভ হয় ২০০ টাকা। তারমানে প্রতিদিন ১০০০ টাকার হিসাব মেলাতে হয় তাকে। তাছাড়া নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল ৭-৮ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাটলট্রেনে চড়ে শহরে আসে আরিফ। নগরীর জিইসি মোড় থেকে ২০০ পত্রিকা কিনে সারাদিন ঘুরেফিরে ৫ টাকা দরে বিক্রি করে পত্রিকাগুলো।

১০ বছরের আরিফের জীবন অনেকটা ৩৫-৪০ বছরের অফিসারের মত। যদিও আরিফ এখনো হিসেব মেলাতেও শিখেনি। শুধু শিখেছে পেটের দায়ে সারাদিন পরিশ্রম করতে। প্রতিদিন নিজের সবগুলো পত্রিকা বিক্রি করতে পারে না সে। কাজেই কখনো কখনো লাভ-লস বুঝেও উঠতে পারে না সে। দিন শেষে যেই টাকা জমা হয়, সেটা মায়ের কাছে নিয়ে আসে। সারাদিনে নিজের খরচ ১৫ থেকে ২০ টাকা। মাঝেমধ্যে কিছু বকশিস পায়। এতেই মিলে রাজ্যের খুশি।

আরিফের বাবা আলী আহমেদ ছিলেন পেশায় একজন রিকশা চালক। বছর খানেক আগে এক্সিডেন্টে মারা যান তিনি। আরিফের ভাষ্যমতে তার বাবার পেটের উপর দিয়ে গাড়ী চলে গিয়েছিলো। এর আগেই তার মা তাকে নিয়ে সিলেট থেকে চট্টগ্রামে চলে আসে। মানুষের বাসায় কাজ করে আরিফের মা নুমি ইসলাম। আরিফের বড় ভাই হারিয়ে গেছে কয়েকমাস হলো। হারানোর দিন আরিফকে ২০০ টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে কোনো এক ট্রেনে উঠে যায় সে। এরপর আর ফিরেনি। বয়স ১৩/১৪ হবে। হয়তো ফিরবেও না সে। এর আগে হোটেলে কাজ করতো তার ভাই। পড়ালেখা করার ইচ্ছা আরিফের। তাই স্থানীয় এতিম খানায় ভর্তি করানোর কথা বলেছে তার মা। কিন্তু আরিফের চিন্তা পত্রিকা বিক্রি বন্ধ হলে গেলে টাকা পাবে কোথায় তার মা।

যেখানে সুস্থ সাধারণ মানুষগুলো পরিবারকে নিয়ে ভাবতে কত বিলম্ব করি। সেখানে ১০ বছরের আরিফরা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ে দু’একশ টাকা রোজগারের আশায়। সারাদিন বাসে ট্রেনে ঘুরেফিরে কিছু টাকা উপার্জন করে তারা। আরিফের গায়ের রং কালো। কিন্তু তার গায়ের সাদা গেঞ্জিটা এর চেয়ে কালচে রুপ নিয়েছে। অনেক সময় সকালের হাল্কা নাস্তার পর দুপুর ১টা পর্যন্ত কিছু খায়না সে। গতকাল পত্রিকা কিনতে পারেনি টাকার অভাবে। তাই স্টেশনে ঘুরেছিলো। মাঝেমধ্যে মানুষের কাছে হাত পাতছিলো কিছু খাবে বলে।

পহেলা অক্টোবর। চারিদিকে পথশিশু দিবসের আলাপআলোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে হাতে নিয়েছে বিভিন্ন ইভেন্ট।

আজ ২ অক্টোবর বাংলাদেশে পথশিশু দিবস পালিত হয়। এদিন কিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি কিছু সংস্থা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিশুদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু স্থির চিত্রের সাক্ষী হন। শিশুদিবসের উসিলায় ভালো মন্দ কিছু খাবার, কাপড় জোটে পথ শিশুদের।

৩ অক্টোবর থেকে পথশিশুরা আবারও পথেই থেকে যায়। হয়তো আগের দিনের উপহারের জামাটা গায়ে নিজের কর্মে বেরিয়েছে। সৌজন্যতার খাতিরে জামাটা যে দিয়েছে তার কাজেই গিয়েছে সে। মালিক আগের দিনের সৌজন্যতা ভুলে যায় ততক্ষণে। নিজের কাজ উদ্ধারে ছোট্ট বাচ্চাটাকে কখনো শারীরিক আবার কখনো মানসিক টর্চারও করতে পারেন। এমন পথশিশু, খেটে খাওয়া শিশুর সংখ্যা এদেশে কম না।

কত অল্প সময় এই শিশুরা মানুষের সাথে মিশে যায়। সুন্দর জামা গায়ের একটা মানুষ যখন এদের দিকে একটু হাসিমুখে তাকায়, তারা আনন্দে আপ্লুত হয়। মানুষের হাত ধরে। আপনাকে খুশি করার চেষ্টা করে। তবুও আমাদের মায়ার উদয় হতে একটা পথশিশু দিবস প্রয়োজন হয়। শৈশবের আনন্দ স্মৃতি বলতে এদের কিছুই নেই।

আমরা সোনালী শৈশবকে খুব মিস করি। কিন্তু এরা একটু বড় হতে চায় সবসময়। যাতে অন্তত একটা হোটেল কিংবা দোকানের মালিক তাদের নিতে রাজি হয়। আমরা যখন রেস্টুরেন্টে উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলে যাই, তখন পথশিশুরা সেটা আরেক বেলার খাবার হিসেবে সংরক্ষণ করে। আর পথশিশু হওয়া সত্ত্বেও যার কাঁধে আরেকটা ছোট ভাই বা বোনের ভার আছে, সে ছোট বেলা থেকেই মাতাপিতা বনে যায়। যেই দায়িত্ববোধ আমাদের শিক্ষিত সমাজের ৩০/৩৫ বছরে আসে। সেটা তাদের ৮/১০ বছরে আসে।

তবুও তারা অবহেলিত। পৃথিবী জুড়েই পথশিশুরা অবহেলিত। তাই শুধু একদিনের জন্য নয়। প্রতিদিনই পথশিশুদের জন্য আয়োজন হোক। তাদের জন্য সহজ কর্ম সংস্থান তৈরী হোক। কমপক্ষে আক্ষরিক জ্ঞান যদি তাদের থাকে, তাহলে আমাদের দেশের স্বাক্ষরতার হারও বাড়বে। পাশাপাশি এই পথশিশু দিবসে পথশিশুদের জন্য বছরব্যাপী উদ্যোগ গ্রহণ হোক এবারের প্রত্যয়।

লেখক: শিক্ষার্থী লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়