‘জয় হিন্দ’ স্লোগান সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত
আমরা এখনো দেশপ্রেমিক হতে পারিনি। বড় বড় চেয়ারে বসলে মাথা ঠিক থাকে না। বুদ্ধি লোপ পেতে থাকে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই। বাগাড়ম্বর দিনদিন বাড়তে থাকে। কথা বলার লাগাম টেনে ধরি না। স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন ভিনদেশের স্লোগান দেয়, তখন কিছু অজানা আশংকায় ভেতরটা কেঁপে উঠে।
ভাবতে থাকি আমার দেশটা ঠিক আছে তো? বড় বড় চেয়ারে বসা ভদ্রলোক গুলো দেশপ্রেমিক তো? না সুযোগের অপেক্ষায়? ছদ্মবেশী! সুযোগ পেলে খোলস পাল্টিয়ে ফেলবে। আজ ভীষণ মনে পড়ে গেল হেলাল হাফিজের কবিতার কতিপয় চরণ-
‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।’
বেদনার কবিতা না লিখলেও বেদনাবিধূর হৃদয়ে লিখতে হয় কিছু কথা। মূল কথায় আসি, গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ও জন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘Culture, Peace and Education: From the Perspective of Peoples History’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতায় ভিসি ‘জয় হিন্দ’ বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন।
একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে অন্য দেশের স্লোগান দিয়ে বক্তব্য শেষ করাটা হয়েছে রীতিমতো গর্হিত, শিষ্টাচার ও অশোভনীয় কাজ। শুধু তাই নয় তার শেষের কথাটুকু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য চরম আঘাত। কথা ছোট হলেও শব্দ যুগল যথেষ্ট ভারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। ভিসি সাহেব নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন জয় হিন্দ শ্লোগানের পটভূমি।
‘জয় হিন্দ’ হলো ভারতে একটি স্লোগান ও রণহুঙ্কার। ভারতের জনগণ তাদের দেশের প্রতি দেশপ্রেম প্রদর্শনের জন্য ভাষণ ও স্লোগানের মধ্যে জয় হিন্দ উচ্চারণ করে থাকে। এই শব্দটির অর্থ ভারতের জয় হোক। বা ভারত দীর্ঘজীবী হোক। আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর আবিদ হাসান সাফরানি জয় হিন্দুস্তান কি অর্থাৎ, ভারতের জয় হোক। স্লোগানটির সংক্ষিপ্ত রূপ হলো জয় হিন্দ স্লোগানটি।
স্লোগানটি বিশ্লেষণ করে বলতে পারি- প্রথমত: স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে এ স্লোগান দিতে পারেন কি না? দ্বিতীয়ত: ভুল স্বীকার না করে তার বক্তব্য বিকৃত করার অভিযোগ এনেছেন ভিসি। তৃতীয়ত: বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জয় হিন্দ স্লোগান যে ভিসি দিয়েছেন তা স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই নয়, সেই বিবৃতিতে জয় হিন্দ স্লোগান দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ভারতের সাফাই গাওয়া হয়েছে।
বিবৃতিটির কিয়দংশ নিম্নরূপ- ‘ভিসি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতা, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন এক কোটি শরণার্থীর খাদ্য-বাসস্থানের যোগান দান, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহযোগিতাকরণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন, সর্বোপরি বিশ্বজনমত সৃষ্টির দ্বারা স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তকরণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকারসহ সে দেশের জনগণের প্রতি অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাদের এই সহযোগিতার জন্য ভারত রাষ্ট্রের দীর্ঘায়ু কামনা করতে গিয়ে উপাচার্য মহোদয় অতি প্রাসঙ্গিকভাবেই ‘জয় হিন্দ’ শব্দযুগল ব্যবহার করেন।’
হায়রে ভিসি একাত্তরের কৃতজ্ঞতা এখনো শেষ হলো না। এমন সচেতন জাতির বিবেকের জন্য বড়ই আফসোস হয়। চামচামি আর তোষামোদির দিন এখনো ফুরালো না। পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান যেমন আমাদের সাথে যাই না। চরম আপত্তিকর স্লোগান। যে স্লোগানের আড়ালে ভেসে আসে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। মনে করিয়ে দেয় তিরিশ লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ বাঙালীর আত্মত্যাগের কথা। ঠিক তেমনি জয় হিন্দ শ্লোগান স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও একাত্তরের বন্ধু বেশে এসে একটি দেশের সবকিছু লুটপাট করে শ্মশানে পরিণত করার কথা।
ভিসি সাহেব আপনি জানেন বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ- যার মূল্য ওই সময় ছিলো ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার সবই ভারতীয় বাহিনী ১৫টি বিশাল জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে লুট করে নিয়ে যায়। অথচ সেই অস্ত্রের পুরোপুরি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা ছিলো বাংলাদেশের।
সেইসময় গার্ডিয়ান পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, মিল ফ্যাক্টরির মেশিনাদি যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুটপাট করে ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও খাদ্যশস্য, পাট, সুতা, যানবাহন, এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ, কারখানার মেশিনপত্র, যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুট করে। এই লুটের সম্পদের পরিমাণ ছিল ঐ সময়ের হিসাবে ২.২ বিলিয়ন ডলার।
স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পর সেই লুটেরা ভারতের গুণগান না গাইলেও পারতেন। আসলে এসব তো আপনাদের শুধু মুখের কথা নয়, মনের কথাও। বর্তমান ভারতের বিজেপি সরকার সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী অখণ্ড ভারতের খোয়াবে বিভোর। আপনারা তাদের স্বপ্ন পূরণে এদেশীয় সারথি। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পদ পদবী আপনাদের ভালো লাগে না। যে কারণে আরো সুযোগ সুবিধা পাবার আশায় এই পল্টিবাজির স্লোগান।
আপনার স্লোগান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) লঙ্ঘনের শামিল। যেখানে বলা হয়েছে, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তদবহির্ভূত।
গত বছর ভারতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করেছিল। জেএনইউয়ের ছাত্র সংসদের নেতা কানাহাইয়া কুমারসহ অন্যরা পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দেন বলে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
আবার আগ্রায় গতবছর তাজমহলের সামনে ওরশের সময় হঠাৎ একজন ব্যক্তি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে স্লোগান দেয়। সেখানে ভিডিওতে সেটি ধরা পড়ে। পুলিশ হন্য হয়ে সেই লোকটিকে খুঁজে, কিন্তু লোকটিকে সনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
আর আমাদের দেশপ্রেম কত ঠুনকো। আপনাদের এসব বাগাড়ম্বর ও দেশবিরোধী স্লোগান শুনলেও আর রক্ত গরম হয় না। আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কেননা আপনাদের খুঁটির জোর অনেক বেশি। এজন্য থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দেশপ্রেমিক জনতা জাগলে হয়তো আপনারা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হতেন। সেক্ষেত্রে আপনারা সুপ্রসন্ন ভাগ্যের অধিকারী। আজ জাতি ঘুমন্ত শার্দূল। এদেশকে ভালোবেসে হয়তো এখনো আমরা কবি মহাদেব সাহার মতো মায়াভরা কণ্ঠে বলতে পারিনি,
‘তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো
আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে,
আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে,
চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে।’