ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে আত্মঘাতী
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৪:৫৫ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৫৭ PM
আটাশ বছর পর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সবাই অনেক আশায় বুক বেঁধেছিল।যে ঘোর অমানিশা ভেদ করে একটি হিরণ্ময় প্রভাতের সূচনা হবে। একটি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দীর্ঘদিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের জঞ্জাল, অনিয়ম অব্যবস্থাপনা কি এতো সহজে দূর করা সম্ভব? পদে পদে বাধা বিপত্তি লেগেই আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলোর গণরুম সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। হলের মেস ডাইনিংয়ের খাবারের মান তেমন উন্নতি হয়নি। হলে অবস্থানরত বহিরাগতদের এখনো পুরোপুরি বের করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাবির অধিভুক্ত সাত কলেজ নিয়ে ডাকসুর জোরালো কোনো অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তেমন পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বর্তমান ডাকসুর মেয়াদ সাত মাস হতে চলেছে। দুএকটি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দিয়ে তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। কিন্তু বৃহৎ কাজ এখনো বাকি।
বর্তমান ডাকসুর সদস্যদের কাজের চেয়ে অর্থবিত্তের প্রতি বেশি টান মনে হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন আছে কিন্তু সব সময় নাই নাই খাই খাই স্বভাব মন্দ দেখায়। সদিচ্ছা নিয়ে কাজ শুরু করলে অর্থ কোনো বিষয় নয়। ডাকসুর অর্থ ভান্ডার নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখি জল্পনাকল্পনা।কিছুদিন আগে জিএস ডাকসুর বরাদ্দ বাড়ানো নিয়ে বেশ তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। ডাকসুর জন্য কত টাকা বাড়াতে হবে তাও তিনি বলে দিয়েছেন।বর্তমান ডাকসুর জন্য বাজেট থাকে ঢাবির বাজেটের .২৫ শতাংশ। জিএসের দাবি ছিল তা বাড়িয়ে ১শতাংশ করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডাকসু ও হল সংসদের জন্য প্রতিবছর যে অর্থ নিয়েছে তার হিসাব কিন্তু জিএস চাননি। অথচ এবারের ডাকসুর প্রথম বাজেট অধিবেশনে সকল সদস্য বিগত আটাশ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ডাকসু বাবদ আদায়কৃত অর্থের হিসেব দাবি করেছিল। যে অর্থের পরিমাণ হতে পারে আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। এদিকে গত সাত মাসে ২৪ লক্ষ ৪৮ হাজার ১০০ টাকার ব্যয় অনুমোদন দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু)। গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডাকসু কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যয় করা হয়েছে এই অর্থ। জানি না এ অর্থ কি কাজে ব্যয় করা হয়েছে? কতটুকু কাজে লেগেছে!
কয়েকদিন আগে ডাকসুর কার্যনির্বাহী সভায় নতুন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় নাম দিয়ে মৌলবাদী সংগঠন করা যাবে না। যদিও ডাকসুর গঠনতন্ত্রে ধর্মীয় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বলে কোনো ধারা নেই। প্রস্তাবিত ধারাটি গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করা হবে বলে জানা গেছে। ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিষদ ক্যাম্পাসে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ করেছিল। এবং ১৯৯০ সালের পরিবেশ পরিষদে ঢাবিতে শিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও বিগত বিএনপি জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের সময় ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্যে তৎপরতা দেখা গিয়েছে। এখনো তারা গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে প্রায় সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়।
শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মৌলবাদীর ধোঁয়া তুলে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাব চরম দুরভিসন্ধিমূলক ও প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।এখন মৌলবাদ,জঙ্গী মানেই শুধু মুসলমানদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের কি কখনো মৌলবাদী বলতে শুনেছেন? ইসলামী ভাবাদর্শের অনুসারীদের পাইকারি হারে মৌলবাদী ও জঙ্গি আখ্যা দিয়ে মুলত ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে সাধারণ জনগণ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায়। মনে রাখতে হবে ইসলামের সঙ্গে জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদী, মৌলবাদী কোনো সমার্থক শব্দ নয়। কোনো ধর্মের দুএকজনের অপকর্মের জন্য গোটা ধর্মের অনুসারীদের হেয় প্রতিপন্ন ও জঙ্গী বলে সাব্যস্ত করা চরম ভন্ডামী। আরাকানের বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী যারা রোহিঙ্গাদের ঘর বাড়ি ছাড়া করল, হত্যা করল সেই সব বৌদ্ধদের কি বৌদ্ধ জঙ্গি বলেছেন? ভারতে বিজেপি, শিবসেনা, আরএসএস মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করছে তাদেরকে হিন্দু জঙ্গি বলেছেন? হিটলার খ্রিস্টান হয়ে ষাট লাখ ইহুদি নিধন করলো তাকে কেউ খ্রিস্টান জঙ্গি বলেছেন? সুতরাং এসব ভণিতা বাদ দিয়ে সোজা পথে আসেন। নিজেদের জঙ্গি আচরণ ও কর্মকান্ড আড়াল করতে আর কত সাধু সাজার ভান ধরবেন? জনগণ কিন্তু এতো বোকা নয়।
জগন্নাথ হলে হিন্দুদের বেশ কিছু মৌলবাদী সংগঠন তৎপরতা চালায়। যেমন-১ ইসকন গ্রুপ ২ সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, ৩ শ্রীচৈতন্যের সংগঠন। হল প্রশাসন থেকে এসব সংগঠনের নামে কার্যালয়ও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্বরসতীর পূজার আসর বসে ঢাবির জগন্নাথ হলে। কোনো মুসলমান কি তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছে?ক্যাম্পাসে হিন্দুদের এসব সংগঠন কি নিষিদ্ধ করবেন? না সরাসরি ইসলাম নিষিদ্ধ করতে না পেরে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ নাম দিয়ে ইসলামী সংগঠন নিষিদ্ধ করে তৃপ্তি পেতে চান। নিজেদের মুসলমানের সন্তান পরিচয় দেন । কোনোদিন ঢাবিতে নবীজির জীবন নিয়ে একটি বড়সড়ো মাহফিলের আয়োজন করেছেন বা করার হিম্মত রাখেন? তা পারেন না। আপনারা জাতে মাতাল তালে ঠিক।
ডাকসু অধিবেশনে ধর্ম ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ইশা ছাত্র আন্দোলন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের মতে, ঢাবিতে পরিবেশ পরিষদে'র মাধ্যমে কয়েকটি সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুড়ান্ত গঠনতন্ত্রে কোথাও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা উল্লেখ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) কার্যনির্বাহী সভা শেষে ডাকসু সভাপতি ও ঢাবি ভিসি ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও চেতনার জায়গা। সুতরাং এখানে কোনো ধর্মেরই ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চার সুযোগ নেই। তাদের কোনো ধরনের তৎপরতা ঐতিহ্যগতভাবে এখানে নেই। সেটি যেন কোনো ক্রমেই এদের অনুপ্রবেশ বা কর্মকাণ্ড পরিচালিত না হয় সেবিষয়ে যেন সকলে যত্নশীল থাকে সেজন্য ডাকসুর তরফ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোরামে সেগুলো নিষিদ্ধ করে যেন আইনে পরিণত করা হয় সেই দাবিও জানানো হয়েছে বলেও জানান ভিসি। ডাকসুর এজিএস বলেন, ‘ডাকসুর প্রস্তাব অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। যদিও সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার কথা ভিপি নুর বিবৃতি দিয়ে অস্বীকার করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো ঢাবি কি বাংলাদেশের বাহিরের কোনো জনপদ। আগে বুঝতে হবে ঢাবি বাংলাদেশের বাহিরের কোনো জনপদ বা বিচ্ছিন্ন কোনো ভূখন্ড নয়। বাংলাদেশের ভূখন্ডের মধ্যে অবস্থিত দেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ। যেখানে বাংলাদেশের আইনে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়নি। সেখানে বাংলাদেশের ভেতরের অবস্থিত একটি অংশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। এ প্রস্তাব বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সিদ্ধান্তটি সংবিধানের অন্ততঃ ৮ টি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে গণ্য করা যায়।
অনুচ্ছেদগুলো হলো : ৭ এর ১,২, ২৮ এর ১ ও ৩ , ৩৭ , ২৬ এর ১ও ২ , ৩৬ , ৩৮ এর ক , খ, গ, ঘ , ৩৯ এর ১ ও ২ এর ক , ৪১ এর ১ এর ক, খ, এবং ৪১। বাংদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ডাকসুর নেই।অবশ্য ডাকসু ভিপি নূরুল হক নুর বলেছেন, ডাকসু ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী ও মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা ধর্মকে পূঁজি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়। তবে ব্যাপারটি ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নয়। কারণ সংবিধান অনুযায়ী সেটি আমরা পারি না। এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়।
ডাকসুর কাজ ও লক্ষ্য উদ্যেশ্য কি জানা প্রয়োজন। ডাকসুর গঠনতন্ত্রের ২ নম্বর অধ্যায়ে চারটি উপধারায় ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে, ক.বিভিন্ন হলের ছাত্রদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা। খ.বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বহির্ভূত সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া। গ. প্রকৃত নাগরিক এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা এবং ঘ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার উপাদানকল্প কলেজসমূহ ও দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা।'গঠনতন্ত্রের তৃতীয় অধ্যয়ে ডাকসুর ফাংশনে (কাজ) কয়েকটি উপধারায় বলা আছে, বছরে অন্তত একবার জার্নাল ও অন্যান্য বুলেটিন প্রকাশ করবে, মাঝে মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে, বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের অংশ হিসেবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি প্রেরণ অথবা প্রতিনিধিদের ডাকবে, সমাজ সেবা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সদস্যদের মাঝে সমাজসেবার চেতনা বৃদ্ধি করবে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিগত সাত মাসে ডাকসু কতটুকু দায়িত্ব পালন ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পেরেছে? তা ডাকসুর সদস্যদের আত্মসমালোচনা করে দেখা উচিত। গৌণ বিষয় নিয়ে মাতামাতি না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিভাবে কল্যাণ করা যায় সেদিকে ডাকসুর সদস্যদের মনোনিবেশ করা উচিত। মুক্ত বাক স্বাধীনতা চর্চার তীর্থস্থানে কারো অনুভূতি ও বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বর্তমান ঢাবিতে প্রগতিশীল জোটসহ বিভিন্ন মতাদর্শের ছাত্র সংগঠন ক্রিয়াশীল সেখানে ধর্মীয় ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করা দ্বিচারিতার নামান্তর। মনে রাখা উচিত স্রোতধারা রুদ্ধ করতে চাইলে সেটি বিকল্প পথে বেঁকে যাবার চেষ্টা করবে অথবা বদ্ধ পানিতে শ্যাওলায় পরিণত হয়ে দুর্গন্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।ঠিক তেমনি বাংলাদেশের আইনে যারা তৎপর, আইনশৃঙ্খলা বিরোধী কাজে লিপ্ত নয়। তাদের পথ আটকে দিলে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের উদ্ভব হবে।সেটি আমাদের জন্য বরং বুমেরাং হবে। সেক্ষেত্রে সবার স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।