ভিসি পদ কি ফেভিকলের আটা দিয়ে আটকানো?
বাংলাদেশে বর্তমান পঞ্চাশটির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, যেটি পরে আইন হয়েছে, সে আইনে পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সরাসরি সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক বিবেচনায় ও আনুগত্যের ভিত্তিতে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। অধিকাংশ ভিসি মহোদয় দায়িত্ব পাবার পর হয়ে যান চরম স্বৈরাচারী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং স্বজনপ্রীতিতে আসক্ত। কথা বার্তায় হয়ে যান লাগামহীন, বেপরোয়া।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি তো শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে আন্দোলনের মুখে বাধ্যতামূলক ছুটিতে যেতে বাধ্য হন।
আজ অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে চরম অরাজকতা। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির অপসারণের দাবিতে চলছে ছাত্র আন্দোলন। নিয়োগে দুর্নীতি, ভর্তি বাণিজ্য, প্রকল্পে দুর্নীতি, বিউটি পার্লার ব্যবসা, গোবর ব্যবসা, শিক্ষার্থীদের কটূক্তি, কথায় কথায় বহিষ্কার ইত্যাদি অভিযোগ আছে ভিসির বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য এই প্রশ্নটি ফেসবুকে লিখেছিলেন বশেমুরবিপ্রবির আইন বিভাগের ছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া। এতে খেপে যান ভিসি। তিনি ওই ছাত্রীকে শোনান কুরুচিপূর্ণ কথা। ফোনে ওই ছাত্রীকে ভিসি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী, তা তোর আব্বার কাছে শুনিস! গেছে কোনো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে? এটা (ল ডিপার্টমেন্ট) আমি খুলছিলাম বলেই তো তোর চান্স হইছে, নইলে তুই রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়াতি। বেয়াদব ছেলে-মেয়ে। তিন দিনের বাছুর তুই আবার জানতে চাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’
ওই ঘটনার জের ধরেই জিনিয়াকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরে সেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ানক অবস্থা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসি পন্থী গুন্ডা বাহিনী হামলা করে রক্ত ঝরিয়েছে। ছাত্রীরা ভিসির বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করেছে। চলছে লাগাতার ছাত্র অবস্থান ও আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করা হলেও থেমে নেই আন্দোলন, প্রতিবাদ। নির্লজ্জ ভিসি এখনো পদ আঁকড়ে বসে আছেন। হুমকি ধমকি দিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করতে চাইলেও এখন তার চেয়ার নড়বড়ে অবস্থায়। তার বিদায় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতোমধ্যে ভিসি তার পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।
এখন শুধু বশেমুরবিপ্রবি নয়, দেশের বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁর পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিসির বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা দায়িত্ব পেয়ে হয়ে যান অন্ধ ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তারাই ক্ষমতার লোভ সংবরণ করতে না পেরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হন দুনীতে। দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি বিরুদ্ধপক্ষ হিসেবে। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
এদিকে জানা গেছে বিভিন্ন সময় পাওয়া অভিযোগ আমলে নিয়ে দেশের ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এজন্য আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন, ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিতর্কিত কার্মকাণ্ডে যাদের বিরুদ্ধেই অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের স্বপদ থেকে অপসারণসহ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের অতি উৎসাহী হওয়া ও নোংরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা উচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভিসি বলেছিলেন, আমি জীবদ্দশায় একবার হলেও সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে পেটাতে চাই’। ২০১৮ সালে উনি এ দম্ভোক্তি করেন।
আপনি যে মুখ ফসকে যে এমন কথা বলে ফেলেছেন তা নয়, বরং আপনি বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছেন, এস কে সিনহাকে যদি কোথাও পাই, আমি দু’টো থাপ্পড় দিয়ে ছাড়বো, আমি দেবোই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি এভাবে এমন কথা বলতে পারেন? রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা হাসিলে তারা কতই না উৎসাহী হয়? চেয়ারের মর্যাদা ভুলে যান। রাজনৈতিক আনুগত্য করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকেও বিসর্জন দিতে তারা পরোয়া করেন না।
ভিসি নাসির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাংলোয় একটি বিউটি পার্লারও খুলেছিলেন। তিনি নিজে বিউটি পার্লারের সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে গোবর বাণিজ্যেরও অভিযোগ। তিনি মূলত একজন উদ্ভিদের গবেষক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েও তিনি গাছ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এজন্য তিনি গাছ প্রেমিক উপাধি পেয়েছেন।
এদিকে ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে গবেষণায় ব্যয় ১০ লাখ টাকা। অথচ গাছ কেনা, পরিচর্যা ও গোবর কেনায় ভিসি ব্যয় করেছেন প্রায় কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের এতো অপতৎপরতা ও পদ আঁকড়ে থাকার কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব এবং উন্নয়ন- এই দু’টি বাজেটে বড় অংকের বরাদ্দ হয়, সেটিও সমস্যার একটা কারণ বলে মনে করেন অনেকে। অনেক সুবিধাভোগী মানুষ এই সুযোগটা নিতে চায় ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে। এটা সামাল দিতে গিয়ে ভিসিরা নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
ঢাবির এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, তাঁকে যখন ভিসি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি তিনটি কারণে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উনি কারণ হিসেবে এরশাদের আমলে ভিসি হতে পারেন না বলে জানিয়েছিলেন।
এছাড়া তার ছাত্র জিয়াউদ্দীন বাবলু ডাকসুর এজিএস ছিলেন, সেই ছাত্র স্যারের জন্য সুপারিশ করার কথা বলেছিল। তখন স্যার তাকে নিষেধ করে বলেছিলেন তুমি যদি আমার ছাত্র হয়ে থাকো তাহলে একাজ করো না। দ্বিতীয়ত, যে কারণটি ছিল, তিনি যখন ডিন ছিলেন তখন বুঝতে পারেন প্রশাসন পরিচালনা তার কাজ নয়।
সমকালীন সময়ের ভিসি ফজলুল হালিম চৌধুরীরর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছিলেন নানা ধরনের পদোন্নতি, নিয়োগের সুপারিশ নিয়ে সবাই তার কাছে আসতো। এজন্য তিনি সকালে হাঁটতেই বের হতে পারতেন না। তিনি বলেন, হাঁটতে বের হলে সবাই সুপারিশ নিয়ে এসে ভিড় জমাতো তার কাছে। তাই তিনি বাসায় থাকতেন। তখন আমার মনে হতো ভিসি হলে আমি এই বিচ্ছিন্নতা মেনে নিত পারব না।
তৃতীয় কারণ হিসেবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার বলেন, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা হলে গাদাগাদি করে থাকবে, তাদের জন্য আবাসন নিশ্চিত না করে আমি ভিসির বড় বাড়িতে থাকব সেটা মেনে নিতে পারবো না।
উপরিউক্ত কারণে ঢাবির এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ভিসির পদের মতো লোভনীয় অফার গ্রহণ করেননি। অথচ আজ ভিসি হবার জন্য কতজন লেজুড়বৃত্তি, তোষামোদি ও তেল মর্দনে ব্যস্ত। ভিসি পদ তাদেরকে ফেবিকলের আটার মতো আটকে রাখে। প্রয়োজন তারা আহমদ ছফার কালজয়ী উপন্যাস গাভী বিত্তান্তের ভিসি আবু জুনায়েদ মার্কা ভিসি হতেও কসুর করবে না। তবুও ক্ষমতা, পদ পদবী তাদের চাই।