আশুরার ঐতিহাসিক পটভূমি ও আশুরার রোজার তাৎপর্য
আগামী হিজরি ১০ মহররম মোতাবেক ১০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বাংলাদেশে পালিত হবে পবিত্র আশুরা। আশুরা ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। আশুরা আরবি শব্দ অর্থ দশম তারিখ। হিজরি মাসের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়।
মহররম অর্থ অধিক সম্মানিত। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে মহররমের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার এইদিনে ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
তবে ১০ মহররম ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের কারবালার প্রান্তরে নবীজির দৌহিত্র হুসাইন (রা.) সহ পরিবারে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন বলে ইতিহাসে এ ঘটনাটি বেশি আলোচিত হয়ে থাকে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মহররম তারিখে হযরত হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন।
হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা.) এর ইন্তেকালের পর ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে তার ছেলে এজিদ ক্ষমতায় আরোহণ করে। সে কূট চক্রান্তকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে মুনাফিক ও ইহুদিদের চরিত্রের একজন হয়ে উঠে। এজিদ ক্ষমতায় বসে মদ পানকে বৈধ ঘোষণা, একই সঙ্গে দুই বোন বিয়ে করাকে বৈধসহ নানা অনৈসলামিক বিষয়কে বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। শাসক হিসাবে এজিদ ছিল স্বৈরাচারী অত্যাচারী ও দুশ্চরিত্রের অধিকারী।
তার দুশ্চরিত্র ও খারাপ স্বভাবের কারণে তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের মক্কা, মদিনা, কুফাসহ অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ এজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
কুফার জনগণ এজিদের পরিবর্তে হযরত হুসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে চেয়েছিল। হযরত হুসাইন (রা.) মনে করতেন যে, ইয়াজিদ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে এবং রাসুলের সুন্নাহকে পরিবর্তন করেছে। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। অতঃপর কারবালার সেই হৃদয়বিদারক শোকার্ত দৃশ্যের অবতারণা হয়।
কারবালার ঘটনা ছাড়াও আশুরার দিনটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় এই দিনে আল্লাহ পাক আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেন। আশুরায় পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। আশুরার দিনে হযরত মুসা (আ.) এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মারা হয় ও হযরত মুসা ( আ.) ফেরাউনের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিলেন।হযরত নূহ (আ.) এর কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিল অতঃপর তিনি জুডি পর্বতশৃঙ্গে নোঙ্গর ফেলেছিলেন।
এইদিনে হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আশুরার দিনে হযরত দাউদ (আ.)এর তাওবা আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন। এইদিনে জালিম বাদশাহ নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হযরত ইব্রাহীম (আ.) অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পেয়েছিলেন। হযরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন। এইদিনে আল্লাহ পাক হযরত ঈসা (আ.) কে আসমানে উঠিয়ে নেন। এদিনেই হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। যদি বিভিন্ন তথ্যমতে ঘটনাগুলোর অনেকগুলোই এই দিনে ঘটেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় না।
আবার ওলামায়ে কেরামের প্রচলিত মতে এই দিনে কেয়ামত সংঘটিত হবে। যদিও এই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। মূলত আশুরার বলতে বর্তমানে ইমাম হুসাইনের শহীদের শোকাবহ ঘটনা বেশি স্মরণ করে দেয়। যেদিনটি শিয়া সম্প্রদায় শোকার্ত পরিবেশে পালন করে থাকে।
ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরি ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে শাবান মাসে রমজানের তিরিশ রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে নফল রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের পর সর্বাধিক উত্তম রোজা হলো মহররম মাসের রোজা। আর ফরজের পরে সর্বাধিক উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’ (মুসলিম শরীফ)
হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) বলেন, রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা)
রাসুল (সা.) আশুরার রোজা নিজে পালন করেছেন। উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কেননা এ রোজা পালনে অতীত গুনাহ মুছে দেয়।হযরত আবু কাতাদা (রা.)হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়।’ [মুসলিম শরীফ]
হযরত আলী (রা.) কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার কাছে উপস্থিত ছিলাম। জবাবে রাসূল (সা.) বলেছিলেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’ [জামে তিরমিজি]
সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, হে রাসুল (সা.)! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে মিলে যায়। তাদের প্রশ্নের জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করবো। [মুসলিম]
হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহেলিয়া যুগে কুরাইশরা আশুরা দিনে রোজা পালন করতো। রাসূল (সা.) ও সেই সময়ে রোজা পালন করতেন। মদিনায় এসেও তিনি রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও নির্দেশ দিলেন। রমজানের রোজার আদেশ নাজিল হলে আশুরা দিবসকে বর্জন করা হয়। এখন কেউ চাইলে তা পালন করুক, আর চাইলে তা বর্জন করুক।’ [বুখারি]
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.)-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি। [বুখারি]
আশুরার রোজা পালন নিয়ে অসংখ্য হাদিস রয়েছে। যে হাদিসগুলো আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছে। যারা আশুরার রোজা রাখতে চায় তাদের সর্বনিম্নে দুটো রোজা রাখতে হবে। দুটো রোজা পালন কারী হাদিসের বর্ণনামতে অশেষ ছোয়াবের অংশীদার হবেন। আশুরার দিনে রোজা রাখার পাশাপাশি কারবালার বিয়োগান্তক শোকাবহ ঘটনা ইমাম হুসাইনের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণে রাখতে হবে।কেননা ইমাম হুসাইন আমাদের শিখিয়েছেন অন্যায়, জুলুম, শোষণের কাছে কখনো মাথা নত নয়। জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের তেজ তৈরি করতে হবে।
প্রয়োজনে বুকের তপ্ত খুন দিতে হবে, সত্য ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হতে হবে অকুতোভয় নির্ভীক ও অবিচল।শেষ করি কবি নজরুলের মহররম কবি দিয়ে,
ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।
উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর।
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা
শমশের হাতে নাও বাধ শিরে আমামা
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নাকিবের তুর্য
হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য
জাগো ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দারী হাঁক
শহীদের দিলে সব লালে লাল হয়ে যাক।