০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৫:৩১

অকালে চলে যাওয়া সালমান শাহ ও কিছু মনে পড়া কথা

সালমান শাহ   © ফাইল ফটো

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। আজ থেকে তেইশ বছর আগে। দিনটি ছিল শুক্রবার। আজকের দিনের মতই একটি দিন। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে একটি দিন ছিল। সেই দিনটিতেই মাত্র চার বছর বাংলা সিনেমায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে ২৫ বছর বয়সে অকালে চলে যান সময়ের আলোচিত অভিনেতা, মহা তারকা সালমান শাহ। যদিও তার মৃত্যুর ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। তার অকাল মৃত্যুতে সেই সময় অনেক তরুণ-তরুণী সুইসাইড করেছিল। মিছিল মানববন্ধন প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ২৩ বছরের সালমান হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা না হওয়াটা দুঃখজনক।

সেই সময় বিটিভিতে শুক্রবারে বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। ওই দিনটির জন্য তীর্থের কাকের মতো আমার ন্যায় অনেকেই প্রতীক্ষায় থাকতো । দিন যেন ফুরায় না। সেই কাঙ্ক্ষিত শুক্রবার কেন দ্রুত আসে না। মনের অজান্তেই ভেতরে কেমন যেন ঝটপট অনুভব করতাম। কবে আসবে সেই শুক্রবার।

রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হওয়ায় বাড়িতে রেডিও-টিভি নিষিদ্ধ ছিল। যদিও সেই সময় বড় ভাইয়ের একটি ক্যাসেটপ্লেয়ার ছিল। বেশিরভাগ সময় সেটাতে ধর্মীয় নানা বয়ান বাজতো। বাবা শুক্রবার দিন অন্তত বাড়িতে থাকতো। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে টিভিতে সিনেমা দেখা ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদী পারাপারের মতো কঠিন ব্যাপার। বাবা দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে এসে যখন বিছানায় হেলে-দুলে ঘুমের প্রস্তুতি নিতেন। তখন আমার দু’চোখ থাকতো বাবার চোখের দিকে নিবিষ্ট । বাবা ঘুমের জন্য চোখ মুদিলেই যেন বিশ্ব জয়ের আনন্দ। চুপিচুপি নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে ভোঁদৌড়।

পাশেই ছিল চাচার বাড়ি। দুতলায় থাকতো ভাড়াটিয়া। শুক্রবারের সিনেমা ওখানেই দেখা হতো। কখনো গ্রামের অন্য কারো বাড়িতেও যাওয়া হতো। একদিন তো সিনেমা দেখতে দৌড় দিয়েছিলাম, কারণ সিনেমা শুরু হতে আর কয়েক মিনিট বাকি। সামনে পড়ল মসজিদের ইমাম। ইমাম সাহেব দু’হাত প্রসারিত করে আমাকে ট্রাফিকের মতো আটকিয়ে দিলেন।

আমার তো ভয়ে থরথর অবস্থা, প্রচণ্ড ঘেমে গেছি। ইমাম সাহেব আমার দৌড়ের গতি আর দ্রুত ব্রেকে কষা দেখে বুঝে ফেললেন আমি কি উদ্দেশ্যে সাধনে দৌড় দিয়েছি। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না আজ কি দিন? তিনি নাকি বাবাকে আমার সিনেমা দেখার কাহিনী বলে দেবেন। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সব আনন্দ হাসিখুশি মুহূর্তের মধ্যে মাটি হয়ে গেল। আজ নিশ্চিত বাড়িতে কিয়ামত শুরু হবে। কি আর করার একবুক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। ওই দিনের মতো সিনেমা দেখা বয়কট করলাম।

বাবাকে অবজারভেশন করছি বেতার মাধ্যমে তার কাছে সংবাদ পৌঁছেছে কি না। সবকিছু অবলোকন করে বুঝলাম ইমাম সাহেব হয়তো ভুলে গেছেন। সুতরাং ঐ যাত্রায় বিশাল মারধর ভর্ৎসনা ও চুপিসারে সিনেমা দেখার ওপর ১৪৪ ধারা জারি করা থেকে নিস্তার পেলাম। সেই সময় রাতের বেলায় আলিফ লায়লা, আলি বাবা চল্লিশ চোর সিরিয়ালগুলো ছিল যেমন হৃদয়স্পর্শী তেমনি হররও।

একদিন শুক্রবার সিনেমা দেখছিলাম বিটিভিতে সেই সংবাদের বিরতি চলছিল, সংবাদের মধ্যে হঠাৎ সালমান শাহ অভিনীত সিনেমার কিছু দৃশ্য দেখানো হয়। সম্ভবত বিকেল পাঁচটার সংবাদ ছিল। আমি তখন সেই সংবাদ এবং সালমান শাহের সিনেমার দৃশ্যের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারিনি। পরে লোকমুখে শুনলাম সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। সেদিন আনুমানিক সকাল ১১টায় তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।

সেসময়ে সালমান শাহের কোনো সিনেমা আমার দেখা হয়নি। সিনেমা হলেও কখনো যাওয়া হয়নি। আমার সমবয়সী চাচাতো ভাই ছিল সালমান শাহের একনিষ্ঠ ভক্ত। সালমান শাহের সব স্টাইল পোশাক-আশাক সবকিছু সে ফলো করতো। সালমান শাহের মৃত্যুর পর তার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা যা ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায়, কেয়ামত থেকে কেয়ামত এবং সত্যের মৃত্যু নেই সিনেমা ভিসিআরে দেখে তখন সালমান শাহের রীতিমতো ভক্ত হয়ে যাই।

সালমান শাহের আসল নাম শাহরিয়ার ইমন চলচ্চিত্রে নাম ছিল সালমান শাহ তার মোট ২৭টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। দু’চারটে সিনেমা ছাড়া সবগুলো সিনেমা ছিলো সুপার হিট। সংলাপে সাবলীলতা, অভিনয়ে দারুণ দক্ষতায় তিনি সময়কে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনন্য স্টাইল,হরেক ফ্যাশন দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি অল্প সময়ে নিজের আসন করেছিলেন পাকাপোক্ত।

তার অভিনীত সব চরিত্রেই ছিলো নতুনত্বের মাত্রা। কাউবয় হ্যাট, হুডি শার্ট, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, গগলস, লং কোটে ডিটেকটিভ লুক, কানে দুল, ফেড জিন্স, মাথার স্কার্ফ, ফ্যাশন সেন্স- সবকিছু মিলিয়ে সালমান হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ। অল্প সময়ে হয়ে ওঠেছিলেন তিনি তারুণ্যের আইডল স্টাইল আইকন। তার হাত ধরেই বাংলা সিনেমা ক্রমেই আসীন হচ্ছিল স্বীয় উচ্চতায়।

লেখক সিলেট শহরে সালমান শাহের পৈত্রিক ভিটায়

একঘেয়ে অভিনয় আর স্টাইল দেখতে দেখতে এদেশের দর্শকরা যখন ভীষণ ক্লান্ত তখন দর্শকদের সামনে সালমান হয়ে আসেন হার্টথ্রব সুপার স্টার হিসেবে। তার রোমান্টিক, মেলোড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, অ্যাকশন ছিল মন মনোমুগ্ধকর। তিনি যেন বাংলা চলচ্চিত্রে এলেন ধূমকেতু হয়ে। আসলেন, জয় করলেন, চলে গেলেন।

গত বছর সৌভাগ্য হয়েছিল সিলেট শহরে অবস্থিত তার পৈত্রিক ভিটা পরিদর্শনের।তার বাড়িতে সব সময় প্রবেশের অনুমতি মিলে না। যে বাড়িতে কেটেছে সালমানের জীবনের কিছু দুর্দান্ত ও দুরন্ত সময়। এখনো সালমানের নামে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে তার বাড়ি, বিস্মৃত স্মৃতি ও নানা অর্জনের সম্ভার নিয়ে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত সালমান শাহ ভিলা। যে বাড়িটি দেখভাল করছেন সালমানের মামা। ওপারে ভালো থাকুক বাংলা সিনেমার মহা তারকা সালমান শাহ। আজ প্রয়াণ দিবসে এই হোক প্রার্থনা।

‘ভালো আছি, ভালো থেকো

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’

[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]