০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১৬:৪৫

আজ হিজরি নববর্ষ: যেভাবে পেলাম হিজরি সন

মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

আজ হিজরি ১৪৪১ সন। আরবি চান্দ্র বছর হিজরি সনের আরেকটি নতুন বছরের সূচনা হলো আজ। সেহিসেবে আজ হিজরি নববর্ষ। বিশ্বের প্রায় একশত সত্তর কোটি মুসলমান তাদের ধর্মীয় কার্যাবলীতে হিজরি দিন তারিখ অনুসরণ করে থাকেন। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সাল তথা আরবি তারিখ তথা চান্দ্রমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।কেননা হিজরি সন তারিখ অনুযায়ীই মুসলমানদের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি আবর্তিত। রমজানের রোজা, দুই ঈদ, হজ্জ ও ইসলামের ঐতিহাসিক ঘটনা সবকিছুই হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্কিত।আমাদের দেশে সাধারণ তিনটি পঞ্জিকা ব্যবহার করা হয়ে থেকে বাংলা সন, ইংরেজি সাল ও হিজরি সন।

ইসলাম পূর্ব যুগে ও ইসলামের প্রারম্ভিক পর্যায়ে আরবে নির্দিষ্ট কোনো সন তারিখ প্রচলিত ছিল না। তারা বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করতো , যেমন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হযরত নুহ (আ:) এর বন্যার সন, ইয়েমেনের খ্রিষ্টান রাজা আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তিবাহিনীর নামে আমুল ফিল বা হস্তির বছর, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ, খসরু সন উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া আরবরা যেহেতু বণিক ছিল সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তারা তৎকালীন রোমান সনকে অনুসরণ করতো। প্রকৃতি তথা দিন রাতকে দিন মাস বছরে ভাগ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন,
‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’। (সূরা: ইউনুস আয়াত: ৫) আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে উহার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনজিল; অবশেষে উহা শুষ্ক বক্র পুরোনো খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে।’ (সূরা: ইয়াসিন আয়াত: ৩৮-৩৯)। আল্লাহ পাক আরো বলেন,  ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’। (সূরা: তওবা, আয়াত: ৩৬)

উপরিউক্ত আয়াতে মানব জাতির সুবিধার্থে যে পঞ্জিকা প্রয়োজন তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তৎকালীন মক্কার লোকদের তাওহীদের (একত্ববাদ) দিকে আহবান করায় মক্কার লোকেরা ও তার আপনজনেরা মহানবীর বিরোধিতা শুরু করে।ফলে গোপনে ৩ বছর তিনি ইসলাম প্রচার করেন এরপর আল্লাহর নির্দেশে তিনি সাফা পাহাড়ে সমবেত জনগণের সামনে প্রকাশ্যে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেইসময় থেকেই পথে প্রান্তরে তাকে আহত, অপমানিত, লাঞ্ছিত ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো শুরু হয়েছিল।

এমতবস্থায়ও মহানবী (সা.) অত্যন্ত ধৈর্য ও পরম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি দ্বীনের প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু কাফির মুশরিকরা তাদের নির্যাতনের তীব্রতা বাড়িয়ে দিলে রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নির্দেশে মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রিয় নবী (সা.)-এর মক্কা থেকে ইয়াসরিব (মদিনা ) হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত অর্থ ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা।বিস্তৃত অর্থে হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়াকে । রাসূল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২৭ সফর মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল কুবায় পৌঁছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল মদিনায় পৌঁছেন তিনি। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল তার The Arab Civilization গ্রন্থে বলেন, "Hijrah is the greatest turning point in the history of Islam. "

৬৩২ সালে নবীজীর ওফাত ও হযরত আবু বকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হলেন সেই পর্যন্ত মুসলমানদের একক স্বতন্ত্র কোনো বর্ষ পঞ্জিকা ছিল না।হযরত আবু বকরের (রা.) ইন্তেকালের পর ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন হযরত ওমর (রা.)। তাঁর শাসনামলে একে একে যেমন ইসলামের বিজয় পতাকা তদানীন্তন অর্ধ পৃথিবীর জুড়ে উড্ডীন হয়েছিল তেমনি হযরত ওমরের বহু সংস্কারমূলক কাজ করে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।তার সময়ে হিজরি বর্ষ পঞ্জিকা তথা হিজরি সনের প্রবর্তন কারা হয়েছিল।খুলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বহু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র ও ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের জরুরি কাগজপত্র ইত্যাদিতেও কোনো সন-তারিখ উল্লেখ না থাকায় সেই সময় বেশ অসুবিধায় পড়তে হতো।

ঐতিহাসিক আল-বেরুনি কর্তৃক বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে হিজরি সন প্রবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু মুসা আশআরী ইরাকের কুফার গভর্নর থাকাকালীন সময়ে একটি পত্রে ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ জানান যে , ‘আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পত্র পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে কোনো সন-তারিখের উল্লেখ নেই, যার কারণে আমাদের অনেক অসুবিধে হয়।’ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরে খলিফা হযরত ওমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন। ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা শিবলী নোমানীর হিজরি সনের প্রচলন সম্পর্কে তাঁর আল ফারুক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল কিন্তু সনের উল্লেখ ছিল না।

তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে তাঁর সামনে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত ওমর (রা.) সাহাবায়ে কেরাম ও অন্য শীর্ষ পর্যায়ের সাহাবী ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন।সেই আলোচনা সভায় হিজরি সন প্রবর্তনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মোতাবেক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে।এই সভায় মহানবীর (সা.)এর হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। তৎকালীন আরবে অনুসৃত নিয়ম অনুযায়ী পবিত্র মহররম মাস থেকেই ইসলামি বর্ষ শুরু (হিজরি সনের শুরু) করার এবং জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত ওসমান (রা.)।যদিও মহানবী হিজরত করেছিলেন রবিউল আউয়াল মাসে। আরবি মাস গণনায় বিভ্রান্ত লক্ষ্য করে স্বয়ং আল্লাহ্-এর সংশোধনের জন্য ১০ম হিজরিতে একটি আয়াত অবর্তীণ করেছিলেন সেই আয়াতে হিজরি সনের ১ম মাস মহররম, সপ্তম মাস রজব, ১১তম মাস জ্বিলকদ আর ১২তম মাস জিলহজ বলে উল্লেখ আছে।

এ আয়াতের আলোকে হিজরি সনের মাসসমূহকে সুবিন্যস্ত করা হয়। সেই হিসেবে হিজরতের ১৭ তম বছরে ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সন গণনা শুরু হলো। হিজরি সনের মাসগুলো হলো- মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ।আমাদের মোটামুটি সকলেরই জানা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কালকে চন্দ্রবর্ষ বলা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হিজরতের বছরকে ইসলামি সন গণনার প্রথম বছর ধরা হয়েছে বলে এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। হিজরি সন সাধারণত চান্দ্রবর্ষ হিসাবে গণনা করা হয়। সৌরবর্ষে ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে বছর হয় সেখানে চান্দ্রবর্ষে ৩৫৪ ও ৩৫৫ দিনে বছর হয়। সেক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষে সাধারণত ১০ বা ১১ দিনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

হযরত ওমর ( রা.) প্রবর্তিত হিজরি সন তাঁর এক অমর অক্ষয় কীর্তি। এই হিজরি সনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রিয় নবীজির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সেই ঐতিহাসিক স্মৃতি। যা প্রতিটি মুসলমানকে নতুন হিজরি সনের সঙ্গে বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়।

[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]