চাকরিতে ভারতীয় ও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, এদেশের বেকার তরুণেরা?
আজকাল ব্যাপক আলোচনার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের চাকরিতে ভারতীয়দের গণহারে নিয়োগ ও তাদের অর্জিত অর্থ ভারতে পাঠানো নিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরও। বিভিন্ন এনজিওতে চাকরির খবর। বাংলাদেশের বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ,তথ্য-প্রযুক্তি, বীমা, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে ও ওষুধ কোম্পানিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন বহু বিদেশি নাগরিক।
যেসব দেশের কর্মীরা এদেশে চাকরি করছেন তাদের মধ্যে শীর্ষে আছে ভারত, তারপরে চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কোরিয়ার নাগরিকেরা। এমনিতেই বাংলাদেশ তরুণরা বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, সেখানে বিপুল সংখ্যক বিদেশি নাগরিকদের এদেশে কাজ করতে আসা ও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়াটা বেকার তরুণদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। সরকারি এ হিসাবের বাইরে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরো বেশি বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তথ্যমতে অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার ছিল ২০১০ সালে। সে হিসাবে ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২০ লাখ লোক বেকার ছিল। ২০১২ সালে ২৪ লাখ। ২০১৬ সালে ২৮ লাখ। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখে উঠার আশঙ্কা করছিল আইএলও।
বিপুল সংখ্যক বেকারত্বের এদেশে বিদেশি তথা ভারতীয়দের ব্যাপক উপস্থিতি দেশপ্রেমিক মানুষ ও বেকার তরুণদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশের তরুণ যুবকরা বাইরের দেশে যেখানে দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে দেশের সুনাম বয়ে আনছে। সেখানে টুরিস্ট ভিসায় আসা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া ভারতীয় নাগরিকদের এতো সুযোগ সুবিধা দেওয়া কতটা যৌক্তিক।
বাংলাদেশে অনেক দক্ষ ও যোগ্য তরুণ রয়েছে যারা কাজ না পেয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। এসব তরুণরা একটু সুযোগ পেলে তারা তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকশিত করে দেখাতে পারতেন। যে পরিমাণ ভারতীয়রা এদেশে চাকরি করছেন তা শুনলে অনেকে বিস্মিত না হয়ে পারবেন না।
বছর দুয়েক আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন মোট ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করছেন। তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারতীয়রা। যাদের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন। এরপরে ১৩ হাজার ২৮৬ জন চীনা নাগরিক এদেশে কাজ করছেন।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে পাঁচ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এখানে বসবাস করছেন এর অর্থ ভারতীয়রা বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি করছেন। সরকারি হিসাবের বাইরে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এখন অন্তত ১০ থেকে ১২ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন। ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদেশে বসবাসরত নাগরিকদের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। অথচ ঐ বছরে বাংলাদেশ প্রবাসীদের মাধ্যমে আয় করেছে ১৩.৫৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে ৮ দশমিক ৩২০ বিলিয়ন রেমিটেন্স অর্জন করে। ২০১৪ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স হিসাবে আয় করে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
ভারত বিশ্বের এখন সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ। বিশ্বের প্রায় ১২-১৪ ভাগ রেমিটেন্স তাদের নিয়ন্ত্রণে। ভারতের রেমিটেন্স আহরণকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ পঞ্চম। বাংলাদেশের নাগরিকরা বিশ্বের প্রায় ১৬৫টি দেশে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত আছেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। এই খাতের অর্জিত বৈদেশিক অর্থসহ বাংলাদেশের অর্থ আজ চোরাপথে, অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকেরা ভারতে পাচার করছেন।
ভারতীয়রা বিভিন্ন সময় দাবি করে ভারতে নাকি ২০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী আছে। যদি তাই হয়ে থাকে তাদের পাঠানো রেমিটেন্স কি বাংলাদেশ পাচ্ছে? ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশীরা রেমিটেন্স প্রেরণের তালিকায় ২০ এর মধ্যেও তো নেই।এমনিতে ভারতে বাংলাদেশীদের কাজ করার অনুমতিই দেওয়া হয় না। এমনকি তারা ভিসা নবায়নের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না।
ফলে ভারতের কোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিতেও কাজের অনুমতি মিলে না আমাদের। ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশীরা। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
এদিকে গতকাল খবর বেরুলো রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে চাকরি করছেন। তাদের এ সংখ্যা নাকি ৩০ হাজার। বিভিন্ন এনজিওতে তারা মাসিক ১৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। রোহিঙ্গাদের চাকরি দেওয়া নিয়ে অভিযোগ করা হলেও এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বরাবর তা অস্বীকার করে আসছে।
যদিও সরেজমিনে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি দেবার খবরের সত্যতা মিলেছে। এমনিতে রোহিঙ্গাদের ভারে বাংলাদেশের নাভিশ্বাস অবস্থা সেখানে তাদের এ ধরনের সুযোগ সুবিধা শরণার্থী আইন কানুনের লঙ্ঘন।
বাংলাদেশেরা বেকার তরুণেরা যেখানে চাকরির অভাবে মানবেতর দিনাতিপাত করছে। সেখানে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় এবং কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গার এদেশে নির্বিঘ্নে চাকরি করাটা এদেশের বেকার তরুণদের মর্মাহত করেছে। কক্সবাজারের ঐ এলাকায় রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগণ এমনিতে কোণঠাসা হয়ে আছে। তাদের স্বাভাবিক জীবন আজ বিপর্যস্ত।
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য স্থানীয়দের নাগালের বাইরে।
সময় থাকতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। লাখো বেকার তরুণদের কথা মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বেকার তরুণদের উপেক্ষা করে শুধু ভিনদেশীদের দ্বারা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]