আগস্ট ছাত্র আন্দোলন: দুঃসহ যে স্মৃতি ভুলতে পারি না!
২০০৭ সালের ২০-২২ আগস্ট। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ৬৯'র গণঅভ্যুথান, ৭১'র মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০'র -স্বৈরাচার পতন দিবসের সেই সব দিনগুলোর স্বাক্ষী হওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। তবে আমার কৈশোরের শেষ প্রান্তে এসেই মুখোমুখি হয়েছিলাম আরেকটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামের, ২০০৭ সালের আগস্টের ছাত্র আন্দোলন।
এই আন্দোলন না হলে বেসামরিকের আড়ালে আরেকটি স্বৈরাচারী শাসনের জন্ম নিত। অথচ এই ছাত্র-আন্দোলনের যে সফলতা ছিল তাকে মুছে দেওয়ার জন্য ঐ সময়ের নির্যাতক ও তাদের প্রভুরা যেভাবে অন্ধকারের সমঝোতা খেলায় একটি শ্রেণীকে দখলে নিছিল তেমনি পরবর্তী ক্ষমতাসীন সরকারও আগস্ট আন্দোলনকে "অনভিপ্রেত ছাত্র আন্দোলন" নাম দিয়ে একটি সংসদীয় কমিটি করে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার শেষ আয়োজনটিও সম্পন্ন করেছে। একইভাবে ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ও প্রগতিশীল কথিতরাও ক্ষমতার মোহে পড়ে আগস্ট-আন্দোলন মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেদের যুক্ত করেছে। তাই এ বিষয়ে চিৎকার না করে সেদিনকার দুঃসহ স্মৃতি চারণ করাটাই শ্রেয় মনে করছি—
অনেকটা নিশাচর প্রাণীর মত ফুলার রোডে, পলাশী আর সারা ক্যাম্পাসে বাউন্ডুলে ঘোরাফেরাটাই ছিল আমার নিত্যদিনকার কাজ। কিন্তু বেশি দিন সম্ভব হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক নামে সেনা শাসনের ফরমানে রাতে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা আর পাবলিক লাইব্রেরীতে ঝিমাতে ঝিমাতে রাত কাটানো আমাকে ছেড়ে দিতে হল। তাই বাধ্য হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গতানুগতিক দিন অতিবাহিত করছি। অতঃপর ২০ আগস্ট ২০০৭, আড্ডা চলছিল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে। জানতে পারলাম খেলার মাঠে সেনাবাহিনীর সাথে ছাত্রদের মারামারি হয়েছে। কিছু না বুঝার আগেই দেখি একটা ছোট মিছিল এসে লাইব্রেরীর সামনে। পরবর্তী ঐ মিছিল নিয়ে মল চত্বরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, রাতে খেলার মাঠ-ভিসিচত্বর-টিএসসিতে আর্মি-পুলিশের নিষ্ঠুর তান্ডব, ২০-২২ আগস্ট ক্যাম্পাসজুড়ে দাউ দাউ আগুন, টানা তিনদিন পুলিশের টিয়ারশেলে নাক-মুখ জ্বলে উঠা, টিয়ারশেল পাল্টা পুলিশের দিকে ছুড়ে মারতে হাত পুড়ে ফেলা সবই আজও এক দগদগে স্মৃতি। স্যার এ. এফ. রহমান হলের ছাত্র হওয়ায় আগস্ট আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশি শরীক হওয়ার সুযোগ আমাদের বেশি ছিল। কারণ শেষের দিন আন্দোলনের ব্যাটল ফিল্ড ছিল নীলখেত প্রবেশমুখ।
২২ আগস্ট সারা দেশজুড়ে সেই দাবানল ছড়িয়ে পড়লে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকার কারফিউ চালু করে দেয় । নিদের্শ হল, রাত ৮ টার মধ্যে হল ছাড়তে হবে। চোখেমুখে আতঙ্ক আর অনিশ্চিত গন্তব্যের পথ ধরে ছাত্ররা ছুটছে। প্রথমে হল না ছাড়ার অবুঝ সিদ্ধান্ত অবশেষে ৬.৩০-এ যখন হল ছাড়ছি তখন অজানা এক আতঙ্ক বুকের ভিতর শুরু হল। ঠিক করলাম যাত্রা বারিধারা ডিওএইএস-এ বন্ধুর বাসা। শাহবাগ এসে চারিদিকে মানুষের ঢল দেখে বুঝতে পারলাম কারফিউ নিয়ে কেন এত আতঙ্ক? হাটা শুরু করলাম। বনানী যেতেই প্রায় রাত আটটা। এক রিকশাওয়ালাকে ধরে আর্মির গাড়ির সাইরেনের ভিতর দিয়ে বারিধারা ডিওএইসএস-এ পৌছলাম। পথের অবর্ণননীয় দুঃখ ও আতঙ্কগ্রস্থ মানুষের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
বাসায় পৌছে সিএসবি নিউজে কারফিউ নামক এক ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার রুপ প্রত্যক্ষ করলাম। গাবতলীতে-কমলাপুরে, যাত্রবাড়ীতে অগণিত ছাত্রকে পেটানো হয়েছে, ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ভয়বহতা দেখে-শরীরের প্রত্যেকটি লোম শিউরে উঠল। ঢাকা শহর আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। যে কোনভাবেই এই ঢাকা ছাড়তে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২৩ আগস্ট বারিধারা থেকে বের হলাম। গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। সেই বারিধারা থেকে হেটে হেটে বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা হয়ে পৌছলাম মালিবাগ। সাথে আমার আমার বন্ধু তাজুল ও আরেকজন পরিচিত। সবাই চট্টগ্রামে পৌছব তারপর অন্যকথা।
সাড়ে তিনটার দিকে মালিবাগ এলাকার গলি দিয়ে হাটার সময় হঠাৎ টিভি পর্দায় দেখলাম চারটার পর কারফিউ শিথিল হচ্ছে। তাই কিছুটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে তিনজনই মালিবাগ মোড় হয়ে কমলাপুরের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই ঘটে গেল নির্মম ঘটনাটি। সামনে হঠাৎ আর্মি জীপ। কিছু বুঝার আগেই দেখি আমার বন্ধু ও আরেকজনকে আর্মি রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে। আমি মায়ের সাথে সেলফোনে কথা বলার কারণে তাদের কাছ থেকে থেকে কিছু দুরে ছিলাম। তাদের ওপর সেই নির্মম নির্যাতন দেখে সাথে সাথেই দৌড়। পেছন থেকে চিৎকার আসছে আসছে- 'দৌড়বেন না! দৌড়বেন না!।' এক দৌড়ে সোজা গলির শেষ মাথায়। দেখলাম গলির দুইদিকে আর্মি আর মাঝখানে আমি ও আমার মতো পালানো আরো দুয়েকজন। নিশ্চিত ভয়াবহতার নির্যাতনের দিকে পা বাড়িয়ে একটি বাসায় ঢুকে পড়লাম। মাকে কল দিয়ে জানালাম-'বিপদে আছি। দোয়া করো মা।' অল্প কিছুক্ষণ পরে স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে দেখলাম পকেটে মাত্র ৩০ টাকা। বিপদ যে একা আসে না! কি করব, কোথায় যাব ভেবে পাচ্ছি না। পরিচিত অনেককে ফোন করলাম কেউ কেউ সাড়া দিল না। সবাই যার যার মতো পালাচ্ছে। আবার মা'কে কল দিয়ে জানালাম মোবাইলে ৬০০ টাকা পাঠাতে। গলির এদিক-ওদিক ঘুরে দুই-একটি দোকানে গিয়ে ধরনা দিলম ৪০০ টাকা নগদের বিপরীতে ৬০০ টাকা মোবাইল ট্রান্সফার। অদ্ভুত বাঙ্গালি মুসলমান! কেউ সাড়া দিল না বরঞ্চ একজন প্রস্তাব দিল আপনার মোবাইল সেটটা বিক্রি করে দেন!
আসন্ন বিপদ আর নিজের বোকামিতার মুখোমুখি হয়ে নিরুপায় হয়ে বসে পড়লাম। বারিধারা হেঁটে যাওয়ার শক্তিও আমার নেই, আবার মোবাইল নেটওয়ার্ক অল্প কয়কেমিনিট পর বন্ধ হয়ে যাবে। অনেকটাই সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে একটি দোকানের সাটারের নিচে বসে ভাবছিলাম- গন্তব্য কোথায় হবে? মহান স্রষ্টার কৃপার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার হাতে আর কোন পথ খোলা নেই। তখনই অনেকটাই আকস্মিকভাবে কথা হল আনিস ভাইয়ের সাথে। অতঃপর স্বস্তির নিশ্বাসের প্রাপ্তি, আনিস ভাইয়ের সহযোগিতা, আনিস ভাইয়ের রেফারেন্সে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে কমলাপুর পৌছি। কমলাপুরে টিকেট কেটে অবস্থান নিলাম স্টেশনের দুই তলায় অবস্থিত মসজিদে। সেই বিকাল থেকে রাত সাড়ে ১১টার আগ অবধি মসজিদে বসেই দুই বন্ধুর জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছি। আর কিছুক্ষণ পরপর দুই বন্ধুর পরিবারের মা-বাবা-আত্মীয় স্বজনের আর্তনাদ শুনে নিজের অজান্তেই দু-চোখ ভিজে যেত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রো-ভিসি, প্রক্টর, শিক্ষক, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সবার কাছে দুই বন্ধুর ঘটনা অনেকবারই বলেছি। কিন্তু যেন রোজ হাশরের দিন। সবাই বলল ইয়া নফছি! অতঃপর দুই বন্ধুর অনিশ্চিত গন্তব্য জেনেও আমাকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল সেই দিন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্রতার ছাপ এখনো বয়ে বেড়ানো -খোমেনী ইহসান, এঞ্জেলসহ আজিজ সুপার মার্কেটে হকিস্টিকের আঘাতে আপাদমস্তক থেতলে দেওয়া আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের যোদ্ধাদের কথা ভেবেই নিজের সেই দুঃসহ দিনটার কথা হালকা হয়ে যায়। আমারা চাই, এমন ঘটনা যেন আর ফিরে না আসুক আমাদের জীবনে।
লেখক: ৩৫তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এবং লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।