পূর্ব তিমুর দক্ষিণ সুদান স্বাধীন, কাশ্মীরের স্বাধীনতায় বাধা কোথায়?
এ শতাব্দীর শুরুতে জনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ এবং সবচেয়ে বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুর নামে একটি ভূখন্ড আলাদা হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে জায়গা করে নিল। একই পথ ধরে এ শতাব্দীর প্রথম দশকে আয়তনে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র সুদান ভেঙ্গে দক্ষিণ সুদান নামের আলাদা রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো।
যে ফর্মুলায় পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হলো সেই একই ফর্মুলা প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দায়িত্ব ছিল কাশ্মীরের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা। কিন্তু জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল কাশ্মীরীদের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবিটি এখনো পূরণ করেনি। অথচ পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের চেয়ে কাশ্মীর ইসুটি ছিল বেশি পুরনো ও গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর ইসুটি জাতিসংঘে পর্যন্ত উত্থাপিত হয়েছে তারপরও কাশ্মীরীদের আজাদী আকাঙ্ক্ষা দমিয়ে রাখা মানবিক চেতনা ও আন্তর্জাতিক আইনের লংঘনের শামিল। কাশ্মীরীদের সঙ্গত দাবি আজাদি তথা স্বাধীনতাকে শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মহল যুগের পর যুগ ঝুলিয়ে রেখেছে। এভাবে কতদিন তাদের আজাদির সাধকে দাবিয়ে রাখা যাবে?
ওলন্দাজদের কাছ থেকে ১৯৪৫ সালে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা অর্জনের পর পশ্চিম তিমুর ইন্দোনেশিয়ার অংশ হিসেবেই থেকে যায়। কিন্তু পূর্ব তিমুর ছিল আলাদা পর্তুগিজ উপনিবেশ। এক সময় এর নাম ছিল পর্তুগিজ তিমুর।আয়তন প্রায় ১৫ হাজার ৪১০ বর্গকিমি। আয়তনে আমাদের দেশের প্রায় এক-দশমাংশ যা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তনের সমান। লোকসংখ্যা ১২ লাখের মতো।দেশটির প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। মুসলমানের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। হিন্দু-বৌদ্ধ নেই বললেই চলে।১৬শ শতকের শুরু থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব তিমুর একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল।
১৯৭৫ সালের পূর্ব তিমুরে রাজনৈতিক গোলযোগ ও গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে পূর্ব তিমুর স্বাধীনতা ঘোষণা করলে স্বাধীনতা ঘোষণার ৯ দিনের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর দখল করে নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার ২৭তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে।ইন্দোনেশিয়া ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এটিকে একটি প্রদেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল এ সময়ে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ব তিমুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি গ্রুপের সংঘাত সংঘর্ষ চলে। এতে দ্বীপে অসন্তোষ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।বিভিন্ন সংঘাতে এসময় পূর্ব তিমুরের প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে।হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু ও ঘর ছাড়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের সহিংসতার পর ইন্দোনেশিয়ার সরকার জাতিসংঘ শান্তি রক্ষীদের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৯ সালের ৩০ আগস্ট পূর্ব তিমুরে গণভোটের আয়োজন করে এই গণভোটে ৯০ ভাগের বেশি মানুষ ভোট দেন।প্রায় ৭৮.৫% ভাগ মানুষ পূর্বে তিমুরের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। চুক্তি ও গণভোট অনুযায়ী ২০০২ সালের ২০ মে পূর্ব তিমুরের গণপরিষদে নতুন সংবিধান অনুমোদিত হয় এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়।এরপর পূর্ব তিমুরের নতুন নামকরণ করা হয় República Democrática de Timor-Leste বা গণপ্রজাতন্ত্রী পূর্ব তিমুর। পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা ছিল মূলত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই ।
১৯৫৬ সালে মিশরের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর সুদান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধটা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ সুদানকে নিয়ে। দক্ষিণ সুদানের মাত্র ১০ ভাগ মুসলমান ছিল। বাকি অধিকাংশ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। দক্ষিণ সুদানের আয়তন প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৫ বর্গমাইল।২০০৮ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, দক্ষিণ সুদানের জনসংখ্যা ছিল ৮২ লাখ ৬০ হাজার ৪৯০ জন।সুদানের গৃহযুদ্ধের কারণে ১৯৭২ সালে দক্ষিণ সুদান অঞ্চলে একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়েছিল।
এ অবস্থা বেশিদিন টিকেনি। এ অবস্থা বলবৎ ছিল ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৮৩ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের গৃহযুদ্ধ ।এবার দক্ষিণ সুদানে স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিণত হয় স্বাধীনতার দাবিতে।ফলে সুদান সরকারকে এবার মোকাবেলা করতে হয় স্বাধীনতার দাবিদার সশস্ত্র সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মিকে।বিভিন্ন মহলের পরিসংখ্যান মতে এ যুদ্ধে মারা যায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষ এবং বাস্তুহারা হয় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। দেশটির গণ-মানুষের দাবির মুখে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল সুদান সরকার।তবে এসব গৃহযুদ্ধে দক্ষিণ সুদান পশ্চিমা বিশ্বের কুটনৈতিক ও অস্ত্রের সহযোগিতা পেয়েছিল। যেহেতু তারা ছিলেন খ্রিস্টান।সুদানের দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের পর২০০৫ সালে কমপ্রিহেনসিভ পিস এগ্রিমেন্ট (সার্বিক শান্তি চুক্তি) নামে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সুদান নামক রাষ্ট্রটি উত্তর ও দক্ষিণ অংশে পৃথক হয়ে যায়।
সেইসময় স্বাধীনতার প্রশ্নে চুক্তি অনুযায়ী দক্ষিণ সুদানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষে ৯৯ শতাংশেরও বেশি মানুষ ভোট দেয়।ফলে চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালের ৯ জুলাই দক্ষিণ সুদান প্রজাতন্ত্র নামে পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। ১১ জুলাই জাতিসংঘ তার সংস্থার ১৯৩তম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে স্বাধীন দেশের সৃষ্টি হয়। ভারত স্বাধীনতা আইন (ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট) নামে ব্রিটিশরা ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীরসহ দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান - যে কোন দেশের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে।
দেশীয় স্বাধীন রাজ্যগুলোর মধ্যে কাশ্মীরে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বাস। কিন্তু কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে।১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর আক্রমণ করে ফলে আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেবার চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির।শর্ত অনুযায়ী তিনি ভারতের সামরিক সহযোগিতা পান। ফলে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ যা অব্যাহত ছিল প্রায় দু'বছর ধরে।ভারত এসময় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করলে জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার, কাশ্মীরে গণভোট এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানিয়েছিল। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে, তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।অপরদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।তারপর ১৯৬২ সাল থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন - এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীর বিরোধ নিরসনে পাঁচবার গণভোটের রেজুলেশন নেয়। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে তা কার্যকর করা সম্ভবপর হয়নি। ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীরকে ভারত একীভূত করে।কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে চারবার বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু কাশ্মীরীদের লাভের লাভ কিছুই হয়নি। কাশ্মীরের আয়তন প্রায় ৮৬,০২৪ বর্গমাইল। অধিবাসীর শতকরা ৬০ জন মুসলমান।ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করায় কাশ্মীরের জনগণ নতুন করে সমস্যায় পড়েছেন।
৩৭০ ধারাটি ভারতের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর। ১৯৫৪ সালে এর সঙ্গে ৩৫ -এ ধারা যুক্ত করা হয়েছিল।
৩৭০ ধারার কারণে যে সুযোগ-সুবিধা পেতেন কাশ্মীরীরা ক) জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দাদের দুটি নাগরিকত্ব থাকে।
খ) জম্মু-কাশ্মীরের রাষ্ট্রীয় পতাকা আলাদা।
গ) জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভার কার্যকাল ৬ বছরের, যা অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে ৫ বছরের হয়ে থাকে।
ঘ) এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের ভিতরে ভারতের রাষ্ট্রীয় পতাকার অপমান করা অপরাধ নয়।
ঙ) জম্মু-কাশ্মীরের কোনো মহিলা ভারতের ২৯ রাজ্যের মধ্যে ২-৩টি ছাড়া বাকি রাজ্যর পুরুষের সঙ্গে বিবাহ করলে ওই মহিলার জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিত্ব বাতিল হয়ে যায়।
চ) ঠিক একইভাবে ভারতের অন্য কোনো রাজ্যের কোনো মহিলা জম্মু-কাশ্মীরের কোনো বাসিন্দাকে বিয়ে করলে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকত্ব পেয়ে যান। এমনকি পাকিস্তানি কোনো নারী জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিককে বিয়ে করলেও তার সমস্যা হয় না। সে কশ্মীরের নাগরিকত্ব পায়।
ছ) ৩৭০ ধারার বলে ভারতের সংবিধানের কোনো ধারা জম্মু-কাশ্মীরে কার্যকর হয় না।
জ) ৩৭০ ধারার বলে পাকিস্তানের কোনো নাগরিক জম্মু-কাশ্মীরে থাকলে তিনিও ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যান।
ঝ) জম্মু-কাশ্মীরে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আইন নেই।
ঞ) ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বা আদেশ জম্মু-কাশ্মীরে প্রয়োগ হয় না।
ট) জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দারা ভারতের কোথায়ও জমি কিনতে পারেন না।
সর্বশেষ ৫ আগষ্ট ভারতের সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ায় কাশ্মীরীদের সকল সুযোগ সুবিধা তিরোহিত হলো। এতে করে তাদের আজাদি পাবার আকাঙ্ক্ষা এখন আরো তীব্রতর ও বেগবান হবে। ১৯৮৯ সাল থেকে কাশ্মীরে চলমান আজাদি সংগ্রামে লক্ষাধিক কাশ্মীরী নিহত হয়েছেন। এতোদিন কাশ্মীরীরা স্বাধীনতা অর্জন করতো যদি তারা মুসলমান না হয়ে পূর্ব তিমুর কিংবা দক্ষিণ সুদানের অধিবাসীদের মতো খ্রিস্টান হতেন। মুসলিম হবার কারণেই কাশ্মীরীদের ভাগ্য ললাটে আজ আজাদি অধরা, জাতিসংঘ নিশ্চুপ, বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই মৌনতা। মুসলিম বলেই মানবাধিকার সংগঠনগুলো আজ নীরব দর্শক। নেই তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কিংবা বিবৃতি। মুসলমানদের রক্ত তাদের কাছে গিরগিটি টিকটিকি কিংবা তেলাপোকার চেয়েও অদামী মূল্যহীন। এজন্য তারা এতোটাই নিরুদ্বেগে?
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।