সভ্যতা বনাম মানবিকতা
সভ্যতা এবং মানবিকতা এই দুটি শব্দের সাথে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। সর্বত্র এ কথাগুলো শুনা যায়। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে সভ্যতার মোহে নিজেদেরকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। এক দেশকে অন্য দেশের সাথে, সভ্যতাকে অন্য সভ্যতার সাথে, ব্যক্তিকে ব্যক্তির সাথে তুলনা করি এবং নিজেকে অন্যের মত সাজাতে চাই, হতে চাই আরো উন্নত।
তাইতো আমরা শুনতে পাই অনুন্নত দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ এরং উন্নত দেশ এ কথাগুলো। যেতে চাই গ্রাম ছেড়ে শহরে।
আর এর সাথে যুক্ত হয় মানবিকতা এবং মানবাধিকার নামের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো। এখন আমরা সভ্যতা এবং মানবিকতা সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
সভ্যতা কি?
সভ্যতার ইংরেজি- Civilization যা ল্যাটিন শব্দ- Civis থেকে আগত যার অর্থ নগরে বসবাসরত কোন ব্যক্তি। এর কারণ হলো যখন কোন স্থানের মানুষ সভ্য হয়, তখন তারা ছোট গোত্র বা দলে নয় বরং নগরীর ন্যায় একটি বৃহৎ সুসংগঠিত আকারের দলে একত্রে বাস করে।
সভ্যতা হল কোন জটিল সমাজব্যবস্থা যা নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, প্রতীকী যোগাযোগ প্রণালী, উপলব্ধ স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর নিয়ন্ত্রণের মত গুণাবলি। এর সাথে আরো জড়িত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়াবলী। যেমন- কেন্দ্রীকরণ, মানুষ ও অন্যান্য জীবের আবাসন, শ্রমের বিশেষায়িতকরণ, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, আধিপত্য স্থাপন, ভাস্কর্যরূপ স্থাপত্য, কৃষি এবং শিল্পের বিভিন্ন দিকের পরিবর্তন।
অধিকাংশ সভ্যতারই নিজস্ব কৃষিব্যবস্থা এবং নির্বাচনের ন্যায় সরকার পদ্ধতি রয়েছে। তাদের আরো রয়েছে নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা পদ্ধতি ইত্যাদি। আমরা উল্লেখ করতে পারি সুমেরীয় মিশরীয়, মেসোপটেমীয়, রোমান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সভ্যতার কথা। বর্তমানে বিশ্বে সভ্যতার মাপকাঠিতে আগে আসে পশ্চিমাদের কথা।
মানবিকতা বা মানবাধিকার:
“তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, মানবের কল্যাণের জন্য।” (সূরা আল ইমরান-১১০)
সাধারণত মানুষ হিসেবে মানুষের অধিকারকে মানবাধিকার বলে। যা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। এ অধিকার মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য।
মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্ট করবে না মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার সহজাত একই সাথে আইনগত। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এ ধরনের অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের বিষয়াটি এখন আরো প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে, যখন মানুষের অধিকার সমূহ আঞ্চলিক যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানির কারণে বার বার লঙ্ঘিত হচ্ছে। পরিবার , সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক কর্তারা তাদের অধীনস্থদের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে।
জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights ১ম অনুচ্ছেদে লেখা আছে, All human beings are born free and equal in dignity and rights অর্থাৎ: জন্মগত ভাবে সকল মানুষ স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদা অধিকার।
বর্তমান বিশ্বে Human Rights শব্দটি বহুল আলোচিত ও বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মানবাধিকার বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও অলঙ্ঘনীয় হলেও সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই বার বার লঙ্ঘিত হয়েছে মানুষের অধিকার।
বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারি শাসকরা জনগণের স্বীকৃত অধিকারগুলো পর্যন্ত অবলীলায় হরণ ও দমন করে চলছে। আর দুর্বল জাতিগুলোর সাথে সবলদের আচরণ মানবাধিকারকে করছে উপহাসের বস্তু। ভুলন্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার।
মানুষের অধিকার এবং পৃথিবীব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংগঠন। জাতিসংঘ, সাইরাস সিলিন্ডার, ম্যাগনা কাটা, পিটিশন অব রাইটস, বিল অব রাইটসসহ বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সংগঠন। বিশ্বের অবহেলিত মানুষগুলো স্বপ্ন দেখেছিল নতুন করে বেঁচে থাকার। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে চরম ভাবে। মানবাধিকারের ঝুড়ি ওয়ালারা নিজেদের স্বার্থকে ভালো ভাবে হাসিল করার জন্য ব্যস্ত রয়েছে। লুটেপুটে কেড়ে নিয়েছে মানুষের অধিকার।
যে সংগঠনটি কেবল সাম্য এবং মৈত্রীর কথাই বলেনি দেখিয়েছে হাতে কলমে কি ভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তার নাম ‘মদিনা সনদ’।
সভ্যতা এবং মানবিকতার উপর তুলনামূলক আলোচনা করা যায়:
আমরা এখন কথায় কথায় সভ্যতা, ভদ্রতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গর্ব করি। কখনোবা অন্যকে অভদ্র, অমার্জিত বলে ফেলি। সভ্যতা আমাদের দিয়েছে আধুনিকতা, উন্নত জীবন ব্যবস্থা, দিয়েছে জীবনের গতি প্রকৃতি, কিন্তু পরোক্ষণে কেড়ে নিয়েছে মানবিকতা এক জনের প্রতি অন্য জনের ভালোবাসা।
তাইতো আমাদের দেখতে হয় বিশাল বিশাল অট্টালিকার পাশে বস্তি, আহার বঞ্চিত মানুষের কান্না, গৃহ হারা মানুষের বস্ত্রহীন করুণ অবস্থা।
মনীষীর ভাষায়,
‘এখানেতে বসত আমরা, এখানে থাকি ভাই
আমি অদম্য পথের মানুষ, এখানেতে বসবাস।’
অশান্ত পৃথিবীর বিক্ষুব্ধ জনতার আর্তচিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে উন্মুক্ত গগন আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বে কোটি কোটি অনাহারী বনু আদমের অমানবিক জীবন ব্যথিত করছে সচেতন মানুষকে। তথাকথিত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ এবং অশান্তি বাধিয়ে হত্যা করা হচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে।
পৃথিবী যেমন একদিকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে অবহেলিত, অভুক্ত ভাবে কালাতিপাত করছে হাজারো মানুষ।
বর্তমানে যারাই তথাকথিত মানবাধিকারের সবক দিতে আসে তাদের দ্বারাই তা পদদলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার তারাই ঐসব দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্যের লোভ দেখিয়ে এগিয়ে আসে। এ যেন সেই নীরিহ ছাগলের জন্য বাঘের সাহায্যের (?) হাত দেখানো। বিশ্বে শত শত বিলিয়ন ডলার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ব্যয় হচ্ছে। অথচ ঐসব টাকা দিয়ে যদি গরীব মিসকিন অসহায় মানুষের খেটে খাওয়ার জন্য গরীব দেশগুলোতে মিল, কলকারখানা, হাসপাতাল প্রভৃতি কর্মমুখী ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান করা হত তাহলে লক্ষ কোটি মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের জীবন পরিচালনা করতে পারত।
প্রশ্ন হল ভিন্ন এগুলো করলে শক্তিধর মোড়ল ধনী দেশগুলো তথাকথিত ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জিকির’ তো আর করতে পারবে না।
একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি আমরা অনেক সময় মসজিদে দেখতে পাই যে, ‘মসজিদে ফোন বন্ধ রাখি।’ এবং পরোক্ষণে পাই, ‘জুতা চোর থেকে সাবধান’। এটা আমাদের সভ্যতার নামে যা চলে তার মধ্যে যে শূন্যতা আছে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ আমরা সভ্য হয়েছি ঠিকই কিন্তু চোর থেকে বাঁচতে পারি নি।
বর্তমানে আমরা মানুষরা এমন পর্যায়ে চলে গেছি যে, এক জন মানুষের পাশে অন্য মানুষ মারা গেলেও আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করতে প্রশান্তি পাই। ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। যা পশুত্বকে হার মানায়। রাস্তার অলিতে গলিতে পড়ে থাকে হাজারো গৃহহীন মানুষ। এ সমাজ যাদের নাম দিয়েছে পথ শিশু, ভিক্ষুক, রাস্তার মানুষ। যেনো তাদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নাই।
এখন আমরা অমানবিকতার কিছু চিত্র দেখার চেষ্টা করবো। যা আমাদের প্রতি দিনের চিত্রবহন করে।
* ১ আগস্ট তিতাস নামের একটা মুমূর্ষু স্কুল ছাত্রের প্রতি এ সমাজ কি আচরণ করেছিল যা জাতি দেখেছে। দেখেছে তার পরিবারের নিদারুণ কান্নার ধ্বনি। তা যেন এক সাজানো নাটক। একজন আমলার জন্য।
* ১ আগস্ট দুপুর বেলা, মগবাজারে ‘প্রিয়াঙ্কা শুটিং হাউজ কমিউনিটি সেন্টার’ নামের হাউজটিতে কনের বাবা তুলা মিয়াকে ঘাতক সজীব আহমেদ কি ভাবে হত্যা করে তাও বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে। সজীবের নাকি প্রেমের সম্পর্ক কিছু ওই মেয়েটার সাথে।
* ৬ এপ্রিল বিশ্ববাসী দেখেছে একটা সাজানো নাটকের মঞ্চ, নুসরাত রাফি নামের ছাত্রীটিকে কি ভাবে আগুনে নিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো, ঘাতকরা মেতে উঠেছিল উল্লাসে। সে রেখে গিয়েছে জাতির জন্য প্রেরণা।
* ২৬ জুন (বুধবার) বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফ নামে ছেলেটাকে কি ভাবে তার স্ত্রী নামের প্রতারকের (মিন্নি) সামনে নয়ন বন্ড নামের ঘাতকটি হত্যা করেছিলো যেখানে কয়েক জন মানুষ দর্শকের ভূমিকায় ছিলো। এটিও ছিল মুক্ত আকাশের নিচে একটি সফল মঞ্চ নাটক।
* ২ আগস্ট এ দেশে মানুষের ছেড়ে লাশের মূল্য যেনো মরা হাতি লাখ টাকার মত। তাই ঘটেছে মিরপুর এক নাম্বারে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত শিশু জান্নাতুল আক্তার নামের মেয়েটি এ সমাজ থেকে তার দেহটাকেও নিয়ে যেতে পারে নি। ময়নাতদন্ত নামের বলির শিকার হয়েছে। পরিবার চেয়েছিল অনন্ত মেয়েটা দেহটা নিয়ে যাও, তাই তো লাশ নিয়ে পালানোর চেষ্টা। কি ধরনের আইনের কারণে পরিবারকে অপমানিত হতে হয়েছে পরিবার জাতির কাছে তা জানতে চাই।
* ৩০ জুলাই মানবাধিকার কর্মীর ঘরে আবার মানবাধিকার ভঙ্গ। এমনটি এ ঘটেছে রাজধানীর কাকরাইলের কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির ১৫ তলা ভবনের দশম তলায়। বারান্দার বাইরে ঝুলে ছিল মেয়েটি। খাদিজা নামের মেয়েটি কাজ করত লাভলী রহমানের বাসায়। যদিও জানা যায় অন্য গৃহকর্মী সাথে ঝড়গা হয়েছে, তাই মেয়েটি পালাতে এমন করেছে।
এভাবে জাতি দেখছে কি ভাবে মানবিকতা ভূলন্ঠিত হয়। আছে হাজারো প্রমাণ।
লেখক: শিক্ষার্থী সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইংরেজি ও সাহিত্য বিভাগ