কোটা ব্যবস্থার লয়, তারুণ্যের জয়
স্বাধীনতার পর থেকে ৪৮ বছর ধরে জাতির কাঁধে ভর করে থাকা কোটা নামক অভিশাপ যেন তারুণ্যের পিছুই ছাড়ছিল না। পাকিস্তানীদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহান একাত্তরের স্বাধীনতা অর্জনের পর এদেশ আরেক সীমাহীন বৈষম্যের জালে যেন আটকে পড়ে।
বাংলাদেশ আলাদা মানচিত্র, লাল সবুজের পতাকা পেলেও বৈষম্যের নিগূঢ় হতে বের হতে পারেনি।স্বাধীন দেশে সীমাহীন বৈষম্যের পাহাড় গড়ে উঠে। এ বৈষম্যের একটি জগদ্দল পাথর কোটা বৈষম্য। ধীরে ধীরে এই বৈষম্য তারুণ্যের মেধা ও মননশীলতাকে গ্রাস করতে থাকে। দীর্ঘ দিন ধরে নিয়মের নামে প্রতিষ্ঠিত কোটা নামক অনিয়ম ছিল অনেকের কাছে ন্যায্য পাওনা ও মামা বাড়ির আবদারের মতো। এ অনিয়ম ও বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও দীর্ঘদিন টিকে রাখতে সুবিধাভোগীরা ছিল বেশ তৎপর।
কোটা ব্যবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে।তবে কোথাও এটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। কোটা সাধারণত ১০–১৫ বছরের জন্য সমাজে পশ্চাদপদ বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয়। অনেক দেশে সাময়িক সময়ের জন্য কোটা চালু ছিল তা পরে বিলুপ্ত করাও হয়েছে বা প্রয়োজনে এখনো টিকে আছে ।
আমেরিকায় মোট ১০ বছর রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য ২ শতাংশ কোটা বিদ্যমান ছিল। ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের ১৫ বছরের জন্য কোটা এখনো বিদ্যমান। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের কোনো দেশেই ১৫ শতাংশের বেশি কোটা বলবৎ নেই। সেখানে আমরা কতটা অদূরদর্শী ও বেকুব হলে ৪৮ বছর ধরে ৫৬ শতাংশ কোটা নির্বিঘ্নে পরিপালন করে আসছি! চিন্তা করেন দেশের লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণদের জন্য ৪৪ শতাংশ চাকরি আর কয়েক হাজার হাতে গোনা জনগোষ্ঠীর জন্য ৫৬ শতাংশ চাকরির ব্যবস্থা থাকা কতটা যৌক্তিক?
আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ নারী কোটায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। রেলওয়েতে পোষ্য কোটা ৪০ শতাংশ। তাহলে মেধাবী তরুণরা কি করবে? তাদের ভেতর বেকারত্ব, চাকরি না পাওয়ার বেদনা দিনদিন তাদের বিক্ষুব্ধ করে তুলছিল। যার ফলশ্রুতিতে গত বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্ময়কর জন সমপৃক্ততার কোটা সংস্কার আন্দোলন। এ আন্দোলন একদিনে গড়ে উঠেনি। বেকার তরুণদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখায় তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সুতরাং এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের বিকল্প উপায় উন্মুক্ত ছিল না।হ্যাঁ আমাদের সংবিধানে সুবিধাবঞ্চিত অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষকে কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে তার মানে এটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয় যে বংশ পরম্পরায় যুগযুগ ধরে চলতে থাকবে। মেধাবী তরুণদের বঞ্চিত করে কোটা পদ্ধতিতে কিছু মেধাবী এবং কিছু অমেধাবী নিয়োগ কতটুকু বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিচ্ছবি? অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদ সমূহে চাকরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থার ইতিবৃত্তে দেখা যায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে মেধাতালিকায় ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই কোটা ব্যবস্থাটি বেশ পরিবর্তন করা হয়েছিল কিন্তু বিলুপ্ত করা হয়নি বরং কোটার খাত বাড়িয়ে বৈষম্যের দগদগে ক্ষত তৈরি করা হয়েছিল ।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশের কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, উপজাতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এদের মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত ৩ লাখ।প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত সরকারি চাকরির প্রায় সব পর্যায়েই কোটার চাপে বিপুল সংখ্যক মেধাবীরা আজ দিশেহারা । এর কারণ হলো, এখন স্নাতক-স্নাতকোত্তর পাস করা বেকার যুবকের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। আর কোটার জন্য কত মেধাবীর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে তা ভুক্তভোগী মাত্র মালুম। এখন দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ লাখ ৫ হাজার বেকার রয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৪ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭১ হাজার।
১৯৭২ সাল থেকে চলমান বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা 'বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নিয়মিত বিক্ষোভ, মানববন্ধন, জনসংযোগ, জনমত তৈরির কর্মসূচি পালন করে আসছে।তারা চাকরিতে বিদ্যমান ৫৬শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বিলোপ করে ১০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছিল। শুরুতে তারা দশ দফা দাবিতে আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলে। তাদের দাবি ছিল,প্রথমত: সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বর্তমান কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা। দ্বিতীয়ত:কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।তৃতীয়ত:সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ। চতুর্থত:কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা এবং পঞ্চমত।
চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।এসব দাবি আদায়ে লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ ঘটেছিল।সারাদেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন আন্দোলনটি দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির কাছে নত হতে বাধ্য হয়েছিল । যদিও তাদের নিপীড়ন ও নির্যাতন কখনো বন্ধ হয়নি। ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এদেশের জনগণকে এ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল করেছিল। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এ আন্দোলন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাভারেজ পায়।এদেশের সুশীল, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সমাজও ন্যায্য দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিল।
৮ এপ্রিল ঢাকার শাহবাগে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিপেটা এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করেছিল।বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।১০ই এপ্রিল ২০১৮ সালে কলকাতার বিভিন্ন স্থানেও কোটা পদ্ধতি সংস্কারের জন্য বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলন ও অবস্থান কর্মসূচির কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাবি মেনে নিয়ে, ১১ এপ্রিল ২০১৮ জাতীয় সংসদে তিনি সব ধরনের কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন।
ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৮ বছর ধরে চলা কোটা ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু হতাশার কথা হলো তখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি সরকার। দীর্ঘদিনপর অক্টোবর প্রথম সপ্তাহে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের যে সুপারিশ করেছিল সরকারি কমিটি, তাতে অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। অর্থাৎ ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না।
এসব পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।পরের দিন ৪ অক্টোবর সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৭ মার্চ ১৯৯৭ সালের স্মারকে উল্লিখিত কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করেছিল। পরিপত্রে বলা হয়েছিল- ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ শ্রেণি) এবং ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন ২ শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।এছাড়াও, ৯ম গ্রেড এবং ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করার কথা বলা হয়েছিল ।
কোটা বাতিল পরিপত্র জারি করলেও ধোঁয়াশা কাটছিলো না। গত ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন থাকায় এবং মুক্তিযুদ্ধা কোটাটি সংবেদনশীল হওয়ায় সরকার কিছুটা নিরবতা পালন করে। এসময় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলের কাছে ‘তারুণ্যের ইশতেহার–ভাবনা’ উত্থাপন করেছিল।
এ ইশতেহার–ভাবনায় বেকারত্ব নিরসনে কর্মসংস্থান, চাকরির নিয়োগব্যবস্থা, শিক্ষা ও গবেষণা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলনকারীদের মতামত ও দাবিদাওয়া তুলে ধরেন। এসব দাবি সারা দেশের তরুণ সমাজের দাবি উল্লেখ করে তারা সব রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে তা অন্তর্ভুক্ত করারও আহ্বান জানিয়েছিল। এরপর ছাত্রদের যেকোনো অধিকার আদায়ে এ সংগঠন ছিল তৎপর। ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েও তারা ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। নুর রাশেদ ফারুক বারবার নির্যাতিত হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখায়।
সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই ২০১৯ সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোন ধরনের কোটা থাকবে না বলে আবারও স্পষ্ট করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে। কোটা পদ্ধতি বাতিল করে পরিপত্র জারি করার পর আর কোটা পদ্ধতি বিদ্যমান নেই।এরমধ্যে দিয়ে ৪৮ বছর ধরে পিষ্ট তরুণরা কোটা নামক বৈষম্যের রাহুগ্রাস হতে মুক্তি পেল। তারুণ্যের জয় সূচিত হয়ে কোটা ব্যবস্থা নিক্ষেপিত হলো যাদু ঘরে। 'ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে, অপরিচিত পথে চলার ও অসম্ভব জিনিস আবিষ্কারের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। এ সকল মহানগুণের দ্বারা তরুণদের চালিত হতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি এই আমার বার্তা।”(এ পি জে আব্দুল কালাম)।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক