এনটিআরসিএ’তে কপাল খুলেছে অনেকের, ঝুলে আছে অভাগারা!
বেসরকারি স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি জামায়াত সরকারের প্রশংসিত উদ্যোগ ছিল বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রতিষ্ঠা। এনটিআরসিএ ২০০৫ সালের বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলো এনটিআরসিএ। এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো সেই সময়ের দেশের প্রায় ৩৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সেই সময় বেসরকারি স্কুল কলেজে মাদরাসায় আবেদন করতে এনটিআরসিএ পাশের সনদ লাগত।প্রতিষ্ঠার পর হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে এনটিআরসিএ নিজে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আগের নিয়ম রদ করে এবং সারাদেশে প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল।
সেই নিয়োগ ছিল ব্যাপক বিতর্কিত কেননা সেই নিয়োগ ছিল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোটা ভিত্তিক। ফলে অনেক ভালো নম্বরধারী মেধাবী সেই প্রথম নিয়োগে বঞ্চিত হয়েছিল। এছাড়া আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়েছিল। এতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আবেদন ফি ছিল ১৮০ টাকা। এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে অনেকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের সুযোগ পেয়েছিল। যদিও একটি প্রতিষ্ঠান পছন্দ করে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এ নিয়োগে কেউ কেউ একশ কিংবা দুইশ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেও নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হয়েছিল। এতে আর্থিকভাবে অনেক নিবন্ধনধারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
এক্ষেত্রে নিবন্ধনে ভালো নম্বর পেয়েও নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হবার কারণ ছিল উপজেলা জেলা ভিত্তিক কোটা। অথচ এ সুযোগে সেই সময়ে অনেক কম নম্বরধারী নিয়োগ পেয়েছিল। এতে এনটিআরসি প্রতিষ্ঠার পর বেকার তরুণ তরুণীরা শিক্ষক হবার যে স্বপ্ন লালন করে আসছিল তা অনেকেরই অধরা থেকে যায়। বিভিন্ন সময়ে রাতারাতি বিভিন্ন নিয়ম কানুন প্রবর্তন ও নীতিমালা পরিবর্তনে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে। এ পর্যন্ত এনটিআরসির বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে দেড় শতাধিক রিট হয়েছে। কিছু রিট নিষ্পত্তি করা হলেও এখনো কিছু ঝুলে আছে।
২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশেষ নিবন্ধনসহ ১৪টি শিক্ষক নিবন্ধনের সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা প্রনয়ণের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছিল।বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করে। ফলে এনটিআরসিএ'ও এ নীতিমালা অনুসরণ করে। ফলে ৩৫ ঊর্ধ্ব বয়সীদের এনটিআরসিএ আবেদনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। এতে ৩৫ ঊর্ধ্ব নিবন্ধনধারীরা আদালতে রিট করেছিল। সর্বশেষ ১-১৫তম নিবন্ধনের সনদধারীদের নিয়োগ পরীক্ষা সম্পূর্ণ না করে হুট করে ১৬তম নিবন্ধন পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করায় সংক্ষুব্ধ কয়েকজন সনদধারী আদালতে রিট করেন।
এনটিআরসিএ’র জাতীয় মেধা তালিকায় থাকা শিক্ষক নিবন্ধনধারী রিটকারীদের নিয়োগ না দিয়ে নতুন করে ১৬ তম পরীক্ষার সার্কুলার জারি করা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ইতোমধ্যে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। এভাবে কারণে কখনো অকারণে এটিআরসিরএর অপরিপক্ক ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক রিট হওয়ায় এনটিআরসিআরএ'র কার্যক্রমে শিথিলতা ও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।যদিও বর্তমান এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এর গতি ফিরিয়ে কিছুদিনের মধো কয়েক হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেবার অঙ্গীকার করেছেন।
বর্তমানে দেশে ২৬ হাজার ৬৮ এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে। এতে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর বাইরে এমপিওভুক্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় দুই হাজার।সরকারের নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা হবে প্রায় সাত লাখ। এনটিআরসিএ প্রথম দফায় ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয়ভাবে ১২ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষককে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এনটিআরসিএ প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার দিয়েছিল। যার মধ্যে বিভিন্ন মারপ্যাচের কারণে অনেকে শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ প্রাপ্ত হলেও যোগদান করতে পারেননি। আবার অনেকে দীর্ঘ ছয়মাসেও নিজেদের এমপিওভুক্ত করাতে পারেননি।
নারী কোটা, শুণ্য পদ না থাকা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অসহযোগিতার কারণে অনেকে সুপারিশ প্রাপ্ত হবার পরেও যোগদান করতে পারেননি। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে বলেও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র মাধমে জানা যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) একটি টিম ২০১৪ সালে সরেজমিনে তদন্তে গিয়ে সারাদেশের বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে শিক্ষকতা করছে বলে তথ্য প্রমাণ পায়। এসব শিক্ষক এমপিওভুক্তও হয়েছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও এখনও বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন জাল সনদধারী এসব শিক্ষক।
অভিযোগ রয়েছে, ১ থেকে ১২ তম নিবন্ধনে যারা পাস করতে পারেনি এমন লোকই টাকার বিনিময়ে জাল সনদ নিয়ে চাকরি করছেন। আর এই সরবরাহের পেছনে এনটিআরসিএ’র কর্মকর্তারাও জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তা হলো, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠনের শিক্ষক চাহিদা নিরূপণ, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগের জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও মান নির্ধারণ, জাতীয়ভাবে শিক্ষক মান নির্ধারণ,বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্বাচনের সুবিধার্থে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে উত্তীর্ণ শিক্ষক-প্রার্থীগণের নিবন্ধন, প্রত্যয়ন ও তালিকা প্রণয়ন,
শিক্ষকতা পেশার উন্নয়ন এবং গুনগত মান বৃদ্ধির জন্য সরকারকে পরামর্শ প্রদান।
এনটিআরসিএ আইন বলবৎ হওয়ার পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিও-ভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মান উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।এখনো প্রায় দেড় লক্ষাধিক নিবন্ধনধারী শিক্ষক হবার স্বপ্নে অপেক্ষমান।অচিরেই সকল সমস্যা দূর করে নিবন্ধনধারীদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। পূর্ববর্তী নিবন্ধনধারীদের নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত আপাতত নতুন করে নিবন্ধন পরীক্ষা না নেওয়াটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। নিয়োগের জট দূরীকরণে উত্তীর্ণ নিবন্ধনধারীদের দ্রুত নিয়োগ দেওয়াটাই এখন এনটিআরসিএ'র প্রধান কাজ হওয়া উচিত। বেকার তরুণদের সামনে দীর্ঘ দিন মুলো ঝুলে কালক্ষেপন করাটা হবে অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
এসময় নিবন্ধনধারীদের উচিত হবে নতুন করে রিট না করে পূর্বের রিটসমূহ নিষ্পত্তিতে সহযোগিতা করে এনটিআরসিএ'র কার্যক্রম গতিশীল করতে ভূমিকা রাখা যাতে তৃতীয় দফা সার্কুলার অচিরেই প্রকাশিত হয়ে অসংখ্য বঞ্চিত অভাগাদের কপাল খুলে যায়।এনটিআরসিএ'র এখন কাজ হলো একাধিক প্রতিষ্ঠানে আলাদা আলাদা আবেদন ফি নির্ধারণ না করে এক ফি দিয়ে বেকার তরুণদের প্রতিষ্ঠান পছন্দের সুযোগ করে দেওয়া। যাতে এসময়ে বেকার শিক্ষিত তরুণরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। পছন্দ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান বাছাই করে নিতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক