২৮ জুলাই ২০১৯, ২২:১৭

সত্য কি?

  © টিডিসি ফটো

আমাদের এই পৃথিবী কতইনা বিচিত্রময়। এখানে আমাদের বেঁচে থাকতে হয় সংগ্রাম করে, টিকে থাকার প্রয়োজনে। আমাদের মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও প্রতিকূলতার। তবুও একটা সময় পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীকুল আস্তে আস্তে চলে যায় তার আসল গন্তব্য অর্থাৎ মৃত্যুর দিকে। মানুষ মানুষের মাঝে বেচে থাকতে পারে তার কাজ ও কর্মের মাধ্যমে অনন্তকাল ধরে। যার মধ্যে একটি হতে পারে সত্যবাদীতা।

সত্যবাদীতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘মিথ্যাবাদীদের উপর অভিসম্পাত।’ (আল-ইমরান- ৬১) তিনি আরও বলেছেন, ‘ আল্লাহ তায়ালা মিথ্যুক অপচয়ীকে সুপথ দেখান না।’ (মুমিন- ২৮)

মানুষ কেন সত্য বলতে ভয় পায়, মিথ্যা বলতে পছন্দ করে তা নিয়ে একটি যুক্তিপূর্ণ এবং গবেষণাধর্মী আলোচনা হতে পারে। যা আমাদের সত্য এবং মিথ্যাকে বুঝতে সাহায্য করবে।

সত্য আবার কি?
ব্যঙ্গ করে জানতে চাইলেন পাইলট! কিন্তু শুনার সময় তার নেই। নিঃসন্দেহে ঘন ঘন মত পরিবর্তনের মাঝে আনন্দ আছে, আছে আত্মতৃপ্তি এবং একটি বিশ্বাসে অনড় থাকার মানে হয় বন্ধনের সমতুল্য আবার অনেক সময় তা চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়।

যদিও এ ধারণা দার্শনিকদের আজ আর নেই। কিন্তু সেই মানসিক চিন্তাধারা এখনও বর্তমান আছে। তবে সে আমলের মত অতটা অখন্ডনীয় বিবেচিত হয় না।

মানুষ সত্যের অনুসন্ধানে শুধু পরিশ্রম এবং কষ্ট স্বীকার করে কিংবা খুঁজে পাওয়ার পর তার ভাবনার উপর চেপে বসে মিথ্যার পক্ষ নেয় তা নয়। বরং এক ধরনের কামনা বা ইচ্ছা শক্তিই এর জন্য দায়ী।

গ্রিকদের পরবর্তী প্রজন্মের একটি গোষ্ঠী এ বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, কি কারণে সাধারণত মানুষ মিথ্যা এতো ভালোবাসেন তা নিয়ে। মাথা ঘামিয়েছেন, কারণ তারা তো আনন্দ সৃষ্টি করছেন না, যা সাধারণত কবি-সাহিত্যিকরা করে থাকেন।

কিংবা এতে কোনো লাভালাভের বিষয়ও জড়িয়ে নেই, যা আছে কোনো ব্যবসায়ীর বেলায়। তাহলে শুধু মিথ্যার খাতিরেই মিথ্যা বলে থাকে কিনা ঠিক বলতে পারব না; এ সত্যটি দিবালোকের মত পরিষ্কার। তবে তাতে মুখোশ, ছদ্মবেশ এবং শোভাযাত্রার অর্ধেকও নজরে পড়ে না, যতটা সুস্পষ্ট ও নান্দনিকরূপে দৃশ্যমান হয় মোমের আলোয়।

সম্ভবত সত্যকে মুক্তার মর্যাদা দেওয়া যায় দিনের আলোতে যাকে চমৎকার দেখায়। কিন্তু তাকে হীরক বা ওই রূপ রত্মবিশেষের মূল্য দেওয়া চলে না। যা নানা বর্ণের আলোতে সুন্দর দেখায়। খানিকটা মিথ্যার রং চাপালে কোনো কিছু আনন্দঘন হয়ে ওঠে।

এ ব্যাপারে কি কারো কোন সন্দেহ আছে যে, অসার অভিমত, তোষামোদি, অযথার্থ মূল্যায়ন, খামখেয়ালিপনা ইত্যাদি না হলে কারো মন ভরে না, অনেকেই মনঃক্ষুন্ন হয়, মনে বেদনা ও বিরাগ জন্ম দেয়।

কোন এক রক্ষণশীল ধর্মযাজক কবিতাকে ‘শয়তানের সুরা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণ তাতে কল্পনার খোরাক থাকলেও মিথ্যার ছায়া থাকে। কিন্তু তা এমন মিথ্যা নয় যা আমাদের মনের গভীরে প্রবেশ করে আসর গেড়ে বসে এবং স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে, যেমনটা আগে বলেছিলাম।

কিন্তু জুডার রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পাইলেট যার এইসব বিষয় শুধু মানুষের বিকৃত বিবেচনা ও প্রশ্রয়ের মাঝে বিদ্যমান, যদিও সত্য, যার মূল্য শুধু সে নিজেই নিরূপণ করতে পারেন। অনুসন্ধানকারীই কেবল খুঁজে পান সত্যে বিশ্বাসী মানুষই এর সৌন্দর্য।

দর্শন ও উপভোগের সাথে সাথে মানব চরিত্রে সত্য সর্বোচ্চ স্থান উপলব্ধি করে। ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্টি ছিল ইন্দ্রিয়ের আলো আর সর্বশেষ সৃষ্টি যুক্তির আলো। সৃষ্টির পর নিজের সত্ত্বার আলোতে চলে আর এ আলো মানুষের মনকে আলোকিত করার কাছে ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রথমে তিনি আলো ফেললেন মানুষের মুখে এবং বিভ্রান্তির উপর; তারপর আলো ফেললেন মানুষের মুখে; এখানে তার পছন্দকৃত মানুষকে এ আলোয় আলোকিত করছেন।

এক নগণ্য এপিকিউরিয়ান কবি বলেছিলেন, তীরে দাড়িয়ে সাগরে ঢেউয়ের বুকে দুলতে থাকা তরী দেখতে ভালো লাগে আরো ভালো লাগে দুর্গে দাড়িয়ে নিচের সংঘটিত যুদ্ধ ও দুঃসাহসিক বীরত্ব।

কিন্তু সত্যের সুউচ্চ ভূমিতে দাড়িয়ে বিভ্রান্তি, বিক্ষিপ্ত এবং কুয়াশার ঝড় তান্ডব অবলোকনের সাথে তার কোনো মিলামিলই চলে না। সবসময় এই উপলব্ধি আত্মকরুনার সাথে হয়, আত্মশ্লাঘার সাথে নয়।

সত্যি আমাদের মন যদি পরহিতে পরিচালিত হয়, ঈশ্বরে সমর্পিত এবং সত্যস্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত হত তাহলে এই পৃথিবীই স্বর্গে পরিণত হত।

ধর্ম ও দর্শনের জগৎ যারা চর্চা করেন না, অতি সাধারণ মানুষও স্বীকার করেন যে, কাজে-কর্মে যারা স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা বজায় রাখেন তারা সকলের সম্মান ও ভালোবাসা লাভ করেন। আর মিথ্যার মিশ্রণ সোনা ও রুপার মুদ্রায় খাদ মেশানোর মতো যা ধাতুকে মজবুত করে বটে কিন্তু তা আর খাটি থাকে না।

ঘুরে ঘুরে একেবেকে চলাটা হল সাপের স্বভাব। সাপ পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারে না, চলে পেটে ভর দিয়ে। মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়াটা মানুষের জন্য যতটা লজ্জার আর কোনো পাপ এত লজ্জার কারণ নয়।

মতা ভারি চমৎকার বলেছিলেন, যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মিথ্যাকে কেন এত বড় লজ্জাজনক কাজ মনে করা হয়। তিনি বলেছেন, ‘চুলচেরা বিচারে দেখা যাবে যে, ঈশ^রের উদ্দেশ্যে যে মিথ্যা বলে সে দুঃসাহসী, আর মানুষের উদ্দেশ্যে বললে কাপুরুষ কারণ ঈশ^রের মুখোমুখি হয়ে সে অন্যায় করে আর মানুষের কাছে সত্য লুকিয়ে ছোট হয়।’

অবশ্যই মিথ্যার চাতুরী ও সত্যের স্থলনের জন্য মানুষে উপর ঈশ্বরের চূড়ান্ত বিচার নেমে আসবে; আর ভবিষ্যদ্বাণী তো করাই হয়েছে যে, যখন মর্ত্যে যিশুর পুনরাগমন ঘটবে তখন তিনি বিশ্বাস বলে কোনো কিছুই খুঁজে পাবেন না।

মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যাই ধ্বংস
সত্য, সত্য, সত্যই মুক্তি।
মিথ্যা ধ্বংস, সত্যই মুক্তি।

(বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক ‘ফ্রান্সিস বেকন’ এর ‘অফ ট্রুথ’ রচনার আলোকে)

লেখক: শিক্ষার্থী সরকারি তিতুমীর কলেজ, ইংরেজি ও সাহিত্য বিভাগ।